ইমরান খানের ৩ বছরের দণ্ড: তোশাখানা মামলা কী?
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ইসলামাবাদের হাইকোর্টে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ | ফাইল ছবি
পাকিস্তানের বহুল আলোচিত তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে আদালত তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার পরপরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শনিবার (৫ আগস্ট) ইসলামাবাদের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারক রায় ঘোষণার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ইমরান খানকে দেশটির সক্রিয় রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেছে আদালত।
সাবেক ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ৭০ বছর বয়সী ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপহার সামগ্রী কেনাকাটায় দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিদেশ সফরের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে পাওয়া এসব উপহার সামগ্রীর মূল্য ১৪০ মিলিয়ন পাকিস্তানি রুপির বেশি।
বিজ্ঞাপন
• তোশাখানা বিতর্ক
তোশাখানা বিতর্কের শুরু হয় ২০২১ সালে। ওই সময় দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবি রাষ্ট্রীয় তোশাখানা থেকে বিদেশিদের দেওয়া বিভিন্ন উপহার নামমাত্র মূল্যে কিনে নেন। পরে সেসব উপহার উচ্চ দামে করে দেন তারা।
গত বছরের ২১ অক্টোবর পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপহার সামগ্রী সম্পর্কে ‘মিথ্যা বিবৃতি ও ভুল ঘোষণা’ দিয়েছিলেন বলে জানায়। একই সঙ্গে দেশটির সংবিধানের ৬৩(১)(পি) অনুচ্ছেদের অধীনে তাকে নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে।
বিজ্ঞাপন
পরবর্তীতে দেশটির নির্বাচনী এই পর্যবেক্ষক সংস্থা রাজধানী ইসলামাবাদের একটি দায়রা আদালতে ইমরান খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ওই সময় পিটিআই প্রধানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার আবেদনে ক্ষমতায় থাকাকালীন বিদেশি বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার সম্পর্কে ইমরান খান ইসিপিকে ‘ভুল’ তথ্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
এরপর ট্রায়াল কোর্ট গত ১০ মে পিটিআই চেয়ারম্যানকে অভিযুক্ত করে এবং মামলাটির গ্রহণযোগ্যতা বাতিল চেয়ে ইমরান খানের করা আবেদন খারিজ করে দেয়।
ইসলামাবাদের হাইকোর্ট গত ৪ জুলাই ট্রায়াল কোর্টের রায় বাতিল এবং আবেদনকারীকে পুনরায় শুনানিতে অংশগ্রহণ ও সাত দিনের মধ্যে এই মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
৮ জুলাই দায়রা আদালতের অতিরিক্ত বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে তোশাখানা মামলার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরে ইমরান খানের আইনজীবীরা এই মামলার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আবারও ইসলামাবাদ হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেন।
বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন ইমরান খানের আইনজীবীরা তার ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও এনেছিলেন এবং মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তর চেয়েছিলেন।
২ আগস্ট ট্রায়াল কোর্ট পিটিআই চেয়ারম্যানের জমা দেওয়া মামলার সাক্ষীদের তালিকা খারিজ করে জানায়, ইমরান খান তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যক্রমে সাক্ষীদের ‘প্রাসঙ্গিকতা’ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পরে ইমরানের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে ট্রায়াল কোর্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতেও চ্যালেঞ্জ করা হয়।
পরবর্তীতে পিটিআই চেয়ারম্যান আবার হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ চেয়ে মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তরের আবেদন করেন।
গত ৪ আগস্ট ইসলামাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আমির ফারুক নির্বাচন কমিশনের অভিযোগ দাখিলের এখতিয়ার ও এতে পদ্ধতিগত কোনও ত্রুটি হয়েছে কি না তা পুনঃপরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টিকে ট্রায়াল কোর্টে ফেরত পাঠান।
প্রধান বিচারপতি ইমরান খানের দায়ের করা চারটি পিটিশন— বিচারব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগ, মামলা স্থানান্তর এবং বিচারকের বিতর্কিত ফেসবুক পোস্টের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেন।
শনিবার বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার যখন এই মামলার শুনানি পুনরায় শুরু করেন, তখন পিটিআই চেয়ারম্যানের কোনও প্রতিনিধি তার সামনে উপস্থিত ছিলেন না। এরপর আদালত একাধিকবার শুনানি মুলতবি করে এবং ইমরানের আইনজীবী দলের কেউ হাজির না হওয়ায় রায় সংরক্ষণ করেন।
পরে বিচারক রায় ঘোষণা করে বলেন, পিটিআই প্রধানকে দুর্নীতির জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
• তোশাখানা কী?
ইমরান খান তোশাখানা মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি কয়েকবার এড়িয়ে গেছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী সম্পদের ঘোষণায় তোশাখানা থেকে যেসব উপহার সরিয়ে নিয়েছিলেন, তার বিবরণ গোপন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত শতকের সত্তরের দশকে পাকিস্তানের সরকারি একটি বিভাগ হিসেবে তোশাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বিভাগটি প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও অন্যান্য বিশিষ্ট জনদের দেওয়া উপহার জমা রাখে।
তোশাখানার নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা বা সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের পাওয়া সব উপহার অবশ্যই এই বিভাগে জমা দিতে হবে। যারা এসব উপহার পেয়েছেন তারা পরে এগুলো কিনে নিতে পারবেন। কিনে নেওয়ার পর এসব উপহার বিক্রির বিষয়টি অবৈধ না হলেও অনেকেই এটিকে অনৈতিক বা নীতিগতভাবে ভুল বলে মনে করেন।
ইমরানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয় তাতে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় থাকাকালে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জিনিসের ৫৮টি বাক্স উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন।
গত আগস্টে পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের সবচেয়ে বড় শরিক দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ- নওয়াজের (পিএমএলএন) সদস্য মোহসিন নওয়াজ রানঝা ইমরানের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় তোশাখানা থেকে বিদেশি বিশিষ্টজনদের দেওয়া উপহার কিনলেও নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীতে সেগুলোর উল্লেখ করেননি।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তোশাখানা মামলায় ইমরানকে দোষী সাব্যস্ত করার কথা ছিল দায়রা আদালতের। ওই দিন তার আইনজীবী শুনানি থেকে অব্যাহতির আবেদন করেছিলেন। কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আরও কয়েকটি আদালতে হাজির হতে হয়েছিল। এরপর বিচারক ইমরানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
এর আগেও, দু’বার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন পিছিয়ে দেওয়া হয়। গত ৫ মার্চ ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করতে ইসলামাবাদ পুলিশের একটি দলকে লাহোরে পাঠানো হয়। কিন্তু পিটিআইয়ের প্রধান গ্রেপ্তার এড়িয়ে যাওয়ায় ইসলামাবাদ পুলিশকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়।
পরবর্তীতে গত সপ্তাহে ইমরান খান তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাতিল চেয়ে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে আবেদন করেন। ৭ মার্চ ইসলামাবাদের হাইকোর্ট ইমরানের জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ১৩ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে এবং তাকে দায়রা আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।
গত ৯ জুলাই ইসলামাবাদের অতিরিক্ত ও দায়রা আদালতের বিচারক হুমায়ুন দিলাওয়ার মামলার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেন এবং সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য সাক্ষীদের তলব করেন। এরপর ৫ আগস্ট এই মামলায় ইসলামাবাদের আদালত ইমরান খানকে দোষী সাব্যস্ত করে তিন বছরের সাজা ঘোষণা করে।
সূত্র: ডন, জিও নিউজ।
এসএস