ভারতজুড়ে লাশের স্তুপ
অবিরাম জ্বলছে শ্মশান গলছে ধাতব পাতও, মিলছে না ফুরসত
ভারতে মহামারিতে মৃতদের পোড়াতে দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না শ্মশানের কর্মীরা
করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটে মরদেহ পোড়ানোর গ্যাস এবং কাঠের চুল্লিগুলো অবিরাম জ্বলছে। মহামারিতে মৃতদের পোড়াতে দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেন না শ্মশানের কর্মীরা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, চুল্লিগুলোর ধাতব পাতও টানা জ্বলতে জ্বলতে গলে যেতে শুরু করেছে।
গুজরাটের সুরাটে শ্মশান পরিচালনাকারী একটি ট্রাস্টের প্রেসিডেন্ট কমলেশ শর্মা বলেন, ‘আমরা শতভাগ সক্ষমতা নিয়ে সময় মতো মরদেহ পোড়াতে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করে চলেছি।’
বিজ্ঞাপন
করোনাভাইরাসে মৃতদের যে সংখ্যা সরকারিভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে তার সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের শ্মশান কর্তৃপক্ষ ও শ্মশানের কর্মী, স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্যের হিসেবে ব্যাপক ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় দেশটির শ্মশানগুলোতে অনেক বেশি সংখ্যক মরদেহ স্তুপ আকারে পড়ে আছে। শ্মশানে মরদেহের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
হাসপাতালগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ, অক্সিজেন-ওষুধের তীব্র সংকটের কারণে ইতোমধ্যে দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি হয়েছে।
সোমবার দেশটিতে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন রেকর্ড ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮১০ জন এবং প্রাণহানি ঘটেছে এক হাজার ৬১৯ জনের। দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে; যা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি মোকাবিলায় যে কোনো সরকারের কেন্দ্রস্থলে থাকে বিশ্বাসযোগ্য ডেটা। এটি ছাড়া হাসপাতালের ফাঁকা শয্যা, অক্সিজেন এবং ওষুধের পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, অতিরিক্ত সতর্কতা-সহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুর হিসেবে গড়মিল হতে পারে।
ভারতের সরকারি জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেছেন, কোভিড-১৯ প্রোটোকল মেনে পোড়ানোর কারণে শ্মশানে মরদেহের স্তুপ তৈরি হতে পারে। এমনকি করোনা পজিটিভদের মাত্র ০ দশমিক ১ শতাংশ মারা গেলেও সেটি হতে পারে।
তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা চরম আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছানোর পর হাসপাতালে আসেন এবং পরীক্ষা করার আগেই মারা যান। এমনকি মৃত অবস্থায়ও হাসপাতালে নিয়ে আসার নজির রয়েছে এবং আমরা জানিও না যে তারা আসলে পজিটিভ নাকি নেগেটিভ।
বিরক্তিকর
ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের বায়োস্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড এপিডেমিওলোজি বিভাগের অধ্যাপক ভ্রমর মুখার্জি বলেন, ভারতের অনেক অংশে করোনায় মৃতদের তথ্য লুকানো হচ্ছে। সবকিছুই অত্যন্ত অস্পষ্ট। তারা মনে করেন যে, কেউই পরিস্থিতি পরিষ্কারভাবে বুঝছেন না। আর এটি খুবই বিরক্তিকর।
গুজরাটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সুরাটের কুরুক্ষেত্র শ্মশান ও উমরা নামের দ্বিতীয় আরেকটি শ্মশানে কোভিড-১৯ প্রোটোকল মেনে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রত্যকদিন গড়ে ১০০’র বেশি মরদেহ পোড়ানো হচ্ছে। এই দুই শ্মশানের কর্মীরা ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের তথ্যে সেখানে প্রত্যেকদিন প্রায় ২৫ জন করোনায় মারা যান বলে জানানো হচ্ছে।
রাজ্যের নারায়ণা ট্রাস্ট ‘অশ্বিনীকুমার’ নামের একটি শ্মশান পরিচালনা করে। এই ট্রাস্টের কর্মকর্তা প্রশান্ত কাবরাওয়ালা সেখানে করোনা প্রোটোকল মেনে প্রত্যেকদিন কতজনের মরদেহ পোড়ানো হচ্ছে সেবিষয়ে তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। তবে সম্প্রতি অশ্বিনীকুমার শ্মশানে মরদেহ পোড়ানোর সংখ্যা অতীতের স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রশান্ত বলেন, ‘১৯৮৭ সাল থেকে আমি প্রত্যেকদিন অশ্বিনীকুমার শ্মশানে যাই এবং ২০০৫ সাল থেকে সেখানে প্রত্যেকদিনের কাজে জড়িত ছিলাম। কিন্তু এখন এই শ্মশানে যেভাবে মরদেহ আসছে তা আমি অতীতে কখনই দেখি নাই। এমনকি ১৯৯৪ সালের বিউবোনিক প্লেগ প্রাদুর্ভাব এবং ২০০৬ সালের প্রাণঘাতী বন্যার সময়ও দেখিনি।’
তবে এসব বিষয়ে গুজরাটের সরকারি মুখপাত্রের মন্তব্য জানতে চাইলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি— বলছে রয়টার্স।
বিশ্বে শুধুমাত্র ভারতই যে করোনাভাইরাসে পরিসংখ্যান নিয়ে লুকোচুরি করছে বিষয়টি তেমন নয়। এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার অনেক দেশেও করোনায় মৃতদের পরিসংখ্যান নিয়ে লুকোচুরি চলছে।
অবিরাম জ্বলছে শ্মশান
ভারতের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌয়ের একমাত্র বৃহত্তম সরকারি কোভিড শ্মশান বৈকুণ্ঠধামের পরিসংখ্যান বলছে, এপ্রিল মাসের ভিন্ন ভিন্ন ছয়দিনে রাজ্য সরকার করোনাভাইরাসে মৃতদের যে সংখ্যা প্রকাশ করেছে; সেসব দিনে দ্বিগুণ মরদেহ এসেছে।
করোনায় মৃত মুসলিমদের গণনা করলে এই সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে জানিয়েছে বৈকুণ্ঠধাম। কারণ এই শহরের এক চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠী মুসলিম সম্প্রদায়ের। একটি কবরস্থানের প্রধান কর্মকর্তা আজাদ বলেন, সম্প্রতি সেখানকার কবরস্থানে করোনা প্রোটোকল মেনে মুসলিমদের মরদেহ দাফনের সংখ্যা পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। কবরস্থান সবসময় মরদেহে পরিপূর্ণ থাকছে এবং জানাজা-দাফনের জন্য অনেক মানুষকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’ তবে এসব বিষয়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের মুখপাত্রের মন্তব্য জানতে পারেনি রয়টার্স।
করোনার হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে আসা বৈশ্বিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস বলছে, প্রায় ১৬ মাস আগে শুরু হওয়া করোনাভাইরাস মহামারিতে ভারতে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৫২ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং ১ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯৫ জন মারা গেছেন।
বিখ্যাত মেডিকেল সাময়িকী দ্য ল্যানসেট গত বছরের এক প্রতিবেদনে জানায়, ভারতে করোনায় মোট মৃতদের ৬৫ শতাংশই দেশটির চারটি রাজ্যের। এসব রাজ্য করোনায় মৃতদের শতভাগ হিসেব রেখেছে। কিন্তু দেশটিতে করোনায় মৃতদের এক চতুর্থাংশেরও কম মেডিকেল সার্টিফিকেট পায়। গ্রামীণ এলাকায় এই চিত্র আরো প্রকট। যে কারণে ভারতের অন্য ২৪ রাজ্যে করোনায় মৃতদের সঠিক সংখ্যা হয়তো কখনোই জানা যাবে না।
এসএস