সালার দে ইউনি। বলিভিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম লবণাক্ত সমতল ভূমি। এটি সত্যিই এক অতি অদ্ভুত জায়গা। এর আয়তন ১০ হাজার ৫৮২ বর্গ কিলোমিটার। লবণাক্ত এ মরুভূমিতে রয়েছে ‘মৃত’ ট্রেনের কবর!

ভূতাত্বিকদের মতে, প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে এখানে, ‘মিঞ্চিন’ নামে একটি বিশাল হ্রদ ছিল! যা পরবর্তীকালে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে শুকিয়ে যায়! কিন্তু আজও সেই হ্রদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এই অঞ্চলে অবস্থান করছে ‘উড়ু উড়ু’ এবং ‘পুপো’ নামে দুটি লেক, আর সঙ্গে দুটি বিশাল লবণাক্ত মরুভূমি যার মধ্যে বৃহত্তম হলো এই সালার দে ইউনি।

এই এলাকায় বর্তমানে জমে থাকা লবণের একটা আনুমানিক পরিমাণ শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠবে! এই পরিমাণ আনুমানিক প্রায় ১২ থেকে ১৩ বিলিয়ন টন! লবণ ছাড়াও জিপসাম, সোডিয়াম পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের ভাণ্ডার হিসেবে এই এলাকাটি খনি এলাকা হিসেবে এক সময় খুবই বিখ্যাত ছিল।

তবে আরেকটা কারণেও এই এলাকাটি অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলে মাটির নিচে রয়েছে লিথিয়ামের এক বিশাল ভাণ্ডার। বিশ্বের মোট লিথিয়াম উৎপাদনের আপাতত ৫০ থেকে ৭০ শতাংশই আসে এই অঞ্চলের হাতেগোনা কয়েকটি লিথিয়াম খনি থেকে। আর লিথিয়াম যে বর্তমান জগতে ব্যাটারি এবং বিদ্যুৎ সঞ্চয় সংক্রান্ত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তা কম বেশি সবারই জানা।

এবার আপনি ভাবছেন লবণ হলো, খনিও হলো, কিন্তু আয়না কোথায় গেল? সেটাও বলছি। বছরের একটা সময় যখন এখানকার উষ্ণতা অপেক্ষাকৃত বৃদ্ধি পায়, তখন এখানকার লবণের আস্তরণ কিছুটা গলতে শুরু করে এবং এই গলে যাওয়া লবণে আকাশের প্রতিবিম্ব দেখে সমগ্র এলাকাটাকে যেন একটা বিশাল বড় আয়না বলে মনে হয়।

সেই সময় এখানে পর্যটকদের সংখ্যাও অনেকটা বেড়ে যায়। রাতের অন্ধকারে তারায় মোড়া আকাশ, আর সাদা ধবধবে লবণের প্রান্তরে সেই আকাশের প্রতিবিম্ব, যেন এক অপূর্ব মায়াজগতের সৃষ্টি করে।

লবণে ঘেরা প্রান্তর হলেও বেশ কিছু উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। এখানে ক্যাকটাস জাতীয় কিছু উদ্ভিদের দেখাও মেলে। নির্দিষ্টভাবে কোনো পশু পাখি এখানকার বাসিন্দা না হলেও বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরিযায়ী পাখিরা এখানে দলে দলে ভিড় জমায়! ফ্লেমিংগোদের খুব পছন্দের জায়গা বলিভিয়ার এই নোনা বেসিন। এছাড়াও প্রায় ৮০ টিরও বেশি প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে এই জায়গাতে।

শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বা খনিজ উপাদান নয়, মহাকাশ গবেষণাতেও এই অঞ্চলটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এত বিশাল উন্মুক্ত এবং প্রায় সমতল প্রান্তর-এর সঙ্গে পরিষ্কার আকাশ, গোটা পৃথিবীতে বিরল। আর তাই বিভিন্ন মহাকাশযান, স্যাটেলাইট এমনকি নক্ষত্র বা গ্রহাণুর অবস্থান নির্ধারণেও এই জায়গা থেকে গবেষণা করাটা অনেকটাই সহজ হয়ে দাঁড়ায়।

আরেকটা কারণেও এই জায়গাটা অত্যন্ত অদ্ভুত। এই উন্মুক্ত নোনা মরুপ্রান্তরে রয়েছে ট্রেনের এক বিরাট কবর। একসময় খনি এলাকা হিসেবে এই জায়গাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে জিপসামের খনি ছিল প্রচুর, আর সেখানে পরিবহনের জন্য প্রচুর রেললাইন এবং ট্রেনের ব্যবহার হতো। কালের নিয়মে এক সময়ে সেই খনিগুলো বন্ধ হয়ে যায়, ফলে উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা অব্যবহৃত ট্রেনগুলো এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। ফলে অনেক পর্যটকের কাছে, বলিভিয়ার নোনা বেসিনের এই অংশটি ট্রেন-সিমেট্রি নামেও পরিচিত!

এমএ