গ্রেপ্তার দূত
বিশ্ব মানচিত্রে নাম নেই এমন দেশের দূতাবাসের সন্ধান ভারতে
ভারতের উত্তর প্রদেশ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গাজিয়াবাদ থেকে ভুয়া দূতাবাস চালানোর অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির নাম হর্ষবর্ধন জৈন বলে পুলিশ জানিয়েছে। ৪৮ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি গাজিয়াবাদে একটি বাড়ি ভাড়া করে সেখান থেকেই ভুয়া দূতাবাস পরিচালনা করছিলেন বলে অভিযোগ।
ওয়েস্টার্কটিকা, সাবোরগা, পলভিয়া এবং লোডোনিয়ার মতো তথাকথিত ‘দেশের’ রাষ্ট্রদূত বলে পরিচয় দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন বলেও এসটিএফ জানিয়েছে। মূলত দেশ হিসেবে এগুলোর স্বীকৃতি নেই।
বিজ্ঞাপন
এসটিএফের নয়ডা ইউনিটের এসএসপি সুশীল ঘুলে সাংবাদিকদের বলেছেন, ওই ব্যক্তি ওয়েস্টার্কটিকা, সাবোরগা, পলভিয়া, লোডোনিয়া এবং আরও কয়েকটি তথাকথিত দেশের দূত সেজে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করত।
‘‘ওই ব্যক্তির কাছ থেকে অনেক আপত্তিকর সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে। যে সমস্ত গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে কূটনীতিকদের ব্যবহার করা গাড়ির নম্বর প্লেটের অনুকরণে তৈরি নম্বর প্লেট লাগানো ছিল। এতে কোনও অনুমোদিত সংস্থার স্বীকৃতি ছিল না।’’
বিজ্ঞাপন
• ভুয়া দূতাবাস
কয়েক বছর ধরেই ওই ভুয়া দূতাবাস চালানো হচ্ছিল বলে পুলিশ সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। গাজিয়াবাদের ভাড়া করা বাড়ি থেকেই কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছিল। এসএসপি সুশীল ঘুলে বলেছেন, ওই অভিযুক্ত ব্যক্তি গাজিয়াবাদের কবি নগরের কেবি-৪৫ এর বাসিন্দা। কবি নগরেরই কেবি-৩৫-এ বাড়ি ভাড়া করে ওই বেআইনি দূতাবাস চালাচ্ছিল।
আন্তর্জাতিক স্তরে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে, এমন দাবি জানিয়ে বিদেশে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ আদায় করতেন ওই ব্যক্তি। প্রমাণ হিসাবে গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিভিন্ন ছবিও তাদের দেখাতেন যার সবই জাল করা।
ঘুলে বলেছেন, অন্যদের সামনে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি জাহির করতে এবং তাদের ঠকানোর উদ্দেশ্য নিয়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নিজের মর্ফ করা (বিকৃত) ছবি ব্যবহার করতেন। পুলিশ বলেছে, হর্ষবর্ধন জৈনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, বিদেশে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন তিনি।
তাছাড়া ভুয়া শেল কোম্পানির মাধ্যমে হাওয়ালা (অর্থ স্থানান্তরের একটি পদ্ধতি) চক্র চালাতেন বলেও জানা গেছে। পুলিশ বলেছে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে সন্দেহজনক ও ভুয়া সামগ্রী উদ্ধার করেছে এসটিএফ। এই তালিকায় কূটনৈতিকদের অনুকরণে তৈরি ভুয়া নম্বর প্লেট লাগানো চারটি গাড়ি ছিল। এছাড়া গাড়িতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি অতিরিক্ত ১৮টি ভুয়া নম্বরপ্লেটও ছিল।
১২টি অবৈধ পাসপোর্ট, দুটি ভুয়া প্যান কার্ড এবং ৩৪টি দেশ ও কোম্পানির জাল সিলমোহর, দুটি প্রেস কার্ড, নগদ ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা, বিভিন্ন দেশের মুদ্রা এবং কোম্পানি সম্পর্কিত নথিও উদ্ধার করা হয়েছে।
• প্রতিবেশীরা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি
এডিজি অমিতাভ যশ বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, কয়েক বছর ধরে এভাবেই কাজ করে আসছিলেন হর্ষবর্ধন জৈন। তিনি নিজেকে বিভিন্ন মাইক্রোকান্ট্রির দূত হিসেবে পরিচয় দিতেন এবং তার বিশেষ পদমর্যাদা রয়েছে বলে দাবি করতেন। এর মধ্যে কয়েকটি দেশ অস্তিত্বহীন।
ওই এলাকার বাসিন্দারা ঘুণাক্ষরেও ভুয়া দূতাবাস চালানোর বিষয়টি টের পাননি। কারণ বাড়ির সামনে গাড়ির বহর লেগে থাকত। প্রতিবেশীদের ধারণা ছিল জৈন বাস্তবে একজন কূটনীতিক। ওই এলাকার এক তরুণী বার্তা সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, আমরা ভাবতাম কোনও কূটনীতিক হয়তো এখানে থাকেন। লোকজন খুব বেশি বাড়িতে থাকতে দেখিনি। বাড়ির সামনে অনেক গাড়ি দেখা যেত। বিভিন্ন মাইক্রোকান্ট্রির পতাকাও থাকত।
‘‘কেউ লক্ষ্যই করিনি যে এখানে একটা ভুয়া দূতাবাস চালানো হচ্ছে। কার পক্ষে বোঝা সম্ভব! আমরা ভাবতাম প্রভাবশালী কোনও কূটনীতিক হয়ত এই পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন।’’
• অতীতে গ্রেপ্তার
এর আগেও পুলিশের নজরে এসেছিলেন জৈন। তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১১ সালে এক মামলায় হর্ষ বর্ধন জৈন নামে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এসএসপি সুশীল ঘুলে।
তিনি বলেছেন, সেই সময় তার কাছ থেকে একটি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়েছিল। এই ঘটনায় কবিনগর থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এবার তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেছে গাজিয়াবাদ থানার পুলিশ।
বেআইনি কার্যকলাপ, নথি রাখা ও জালিয়াতি এবং প্রতারণার অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
• ওয়েস্টার্কটিকা
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর ওয়েস্টার্কটিকা নামটিও খবরের শিরোনামে চলে এসেছে। হর্ষ বর্ধন জৈন নামে গাজিয়াবাদের ওই বাসিন্দা নিজেকে যে দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত হিসেবে পরিচয় দিতেন তার মধ্যে একটি এই ওয়েস্টার্কটিকা।
প্রথমবার নাম শুনে একে দূরবর্তী কোনও দেশ বা ছোট দেশ বলে মনে হতে পারে। তবে ওয়েস্টার্কটিকা আসলে একটা কাল্পনিক দেশ। ২০০১ সালে ট্র্যাভিস ম্যাকহেনরি নামের মার্কিন এক নৌ কর্মকর্তা এই দেশ গঠনের দাবি করেন। তিনি মার্কিন নৌবাহিনীতে ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
এর নিজস্ব ওয়েবসাইট, পতাকা, জাতীয় প্রতীক এবং মুদ্রাও রয়েছে। ওয়েস্টার্কটিকাকে অ্যান্টার্কটিকার বরফাচ্ছাদিত অংশের প্রতিনিধি হিসেবে বর্ণনা করা হয়; যার ওপর কোনও দেশের আনুষ্ঠানিক দাবি নেই।
কিন্তু বিশ্বের কোনও দেশ বা জাতিসংঘ একে সত্যিকারের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ওয়েস্টার্কটিকা নামে ট্র্যাভিস ম্যাকহেনরির তৈরি একটি সংস্থাও রয়েছে। একটি অলাভজনক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধিত যার লক্ষ্য পরিবেশ সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো।
ওয়েস্টার্কটিকা সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন গ্র্যান্ড ডিউক ট্র্যাভিস, যার সাহায্যের জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী এবং রয়্যাল কাউন্সিল রয়েছে। এছাড়া গ্র্যান্ড ডুকাল কোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা ওয়েস্টার্কটিকায় প্রণীত বিভিন্ন আইন ব্যাখ্যা করার কাজ করে।
তবে এসব কিছুই ডিজিটাল ও প্রতীকী কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বাস্তব জগতে যার কোনও আইনি বা কূটনৈতিক বৈধতা নেই। ওয়েস্টার্কটিকাতে বিভিন্ন সাম্মানিক পদ বা উপাধি রয়েছে। পিয়ার্সও রয়েছেন যারা এই নিজেদের জ্ঞান, সময় এবং দক্ষতার মাধ্যমে এই সংস্থার উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
প্রসঙ্গত, ওয়েস্টার্কটিকার দূত হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেওয়া জৈনের গ্রেপ্তারের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর ওই সংস্থার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও জারি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, এইচ ভি জৈন ওয়েস্টার্কটিকাকে উদারহস্তে অনুদান দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে তার দেশে আমাদের পরিবেশগত ও দাতব্য মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবকদের দলে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাকে ‘অনারারি কনসাল টু ইন্ডিয়ার’ আনুষ্ঠানিক উপাধি দেওয়া হয়েছিল, কখনই রাষ্ট্রদূতের পদ বা কর্তৃত্ব দেওয়া হয়নি।
জালিয়াতি এবং অন্যান্য অপরাধের জন্য সম্প্রতি জৈনকে গ্রেপ্তারের সময়, তার কাছ থেকে কূটনৈতিক নম্বর প্লেট, পাসপোর্ট এবং ওয়েস্টার্কটিকার সিলযুক্ত বিভিন্ন সামগ্রী পাওয়া গেছে। একজন অনারারি কনসাল হিসেবে এসব সামগ্রী তৈরির অনুমতি তার ছিল না।
‘‘ওয়েস্টার্কটিকা নিজেই কোনও নম্বর প্লেট বা পাসপোর্ট ব্যবহার করে না এবং আমরা কখনও আমাদের প্রতিনিধিদের এমনটা করার অনুমতি বা উৎসাহ দেই না। তার বাসভবনকে দূতাবাস বলে অভিহিত করে জৈন ওয়েস্টার্কটিকার প্রোটোকল লঙ্ঘন করেছেন।’’ তাকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। বিবিসি বাংলা।
এসএস