দিল্লিতে ভাঙারির কাজ করা দুটি পরিবারকে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তবে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও স্থানীয় রাজনীতিকদের দাবি, ওই পরিবারের অন্তত একটি পরিবার ভারতীয় নাগরিক এবং তারা বীরভূম জেলার বাসিন্দা।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মুরারই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকারি দপ্তর থেকে প্রাপ্ত অন্তত ১০টি নথি সংগ্রহ করেছেন, যাতে সংশ্লিষ্ট এক পরিবারের ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ রয়েছে। অন্য একটি পরিবার বীরভূমেরই পাইকর থানা এলাকার বাসিন্দা বলে দাবি করা হলেও তাদের নথি যাচাই এখনো চলছে।

এর আগে ভারতের দিল্লি পুলিশ তথ্য দিয়েছিল, ওই ছয়জন বাংলাদেশি নাগরিক এবং তাদের বাড়ি বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মোলারগাং ছেপুয়ার পাড় গ্রামে।

তবে পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান ও তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম দাবি করেন, যেগুলো বাংলাদেশি হিসেবে দেখানো হয়েছে,  ওই পরিবারের সদস্যদের পূর্বপুরুষদের নামে জমির দলিলসহ একাধিক নথি পাওয়া গেছে, যেগুলোর তারিখ ১৯৫০, ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকের।

এই ঘটনার দুটি পরিবারের বিষয়ে প্রথমে দিল্লি হাইকোর্ট ও কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছেন পরিবারের আত্মীয়রা।

অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে সামিরুল ইসলাম একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেন, ভারতের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে তাদের বাংলাদেশি বানিয়ে ফেরত পাঠানো হলো, সেই বর্ণনা করেছেন পরিবারের সদস্যরা। তারা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন যাতে তাদের ‘নিজ দেশে’ ফিরিয়ে আনা হয়।

তবে ওই পরিবার বর্তমানে বাংলাদেশের কোথায় অবস্থান করছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পুলিশের হাতে আটক, তারপরে বাংলাদেশে

বীরভূমের মুরারই থানা অঞ্চলের ধিতোরা গ্রামের বাসিন্দা আর্জিলা বিবি নামে এক নারী অভিযোগ জানিয়েছিলেন, তার পুত্রবধূ সুইটি বিবি ও দুই নাতি– ১৬ বছর বয়সী কুরবান শেখ ও ছয় বছরের ইমাম শেখকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের প্রধান আসিফ ফারুক বলছেন, সুইটি বিবি ও তার দুই পুত্র দিল্লিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন এবং পশ্চিম দিল্লির রোহিনী এলাকার কেএন কাটজু মার্গ থানা এদের আটক করে বাংলাদেশি সন্দেহে। এরপরে তাদের পশ্চিম দিল্লির এফআরআরও-র কাছে হাজির করা হয়।

এছাড়াও আরেকটি পরিবারের সদস্য সোনালি খাতুন, তার স্বামী দানেশ শেখ ও তাদের ছেলে সাবির শেখকেও একই সময়ে দিল্লির ওই একই থানা আটক করে। এরা পাইকর থানার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তাদেরও এফআরআরও বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দেয়।

এফআরআরও-র নির্দেশনামায় লেখা হয়েছে যে, এই ছয়জনই 'বাংলাদেশি' এবং সেই দেশে এদের ঠিকানা বাগেরহাট জেলা।

কী ঘটেছিল পরিবার দুটির সঙ্গে?

সোনালি খাতুনের ফুফাতো বোন রোশনি খাতুন বলেন, আমরা সবাই হলাম বীরভূম জেলার বাসিন্দা, আমাদের গ্রামগুলো পড়ে ওখানকার পাইকর আর মুরারই থানার ভেতরে। এখন থাকি দিল্লিতে রোহিণী ২৬ নম্বর সেক্টরের বাঙালি বস্তিতে। গত মাসে এই বস্তি থেকেই আমার বোন সোনালি, ওর স্বামী আর বাচ্চা ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। সোনালি চার মাসের গর্ভবতী, সেই অবস্থাতেই ধরে নিয়ে গেছে। আমরা থানায় গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছি, বলেছি ওদের কাগজপত্র দেখুন, ভেরিফাই করুন। কিন্তু কিছুতেই কিছু কাজ হয়নি।

তিনি আরও বলেন, সোনালির আর একটা মেয়ে আছে, সে এখন তার নানির কাছে পড়ে আছে। তারপর শুনলাম ওদের বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওরা ওখান থেকে দু'বার আমাদের ফোনও করেছিল, খুব কাঁদছিল। ভাল করে বলতেও পারলো না ঠিক কোথায় আছে! যাই জিজ্ঞেস করি খালি কাঁদতে থাকে।

আসিফ ফারুক বলেন, এই দুটি পরিবারকে গত মাসে দিল্লিতে তাদের বস্তি থেকে তুলে এনে বিমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের আগরতলায় পাঠানো হয় এবং তারপর সেখান থেকে ত্রিপুরা সীমান্তের কোনো জায়গা দিয়ে বিএসএফ তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।

কী কী নথি যোগাড় হয়েছে?

বীরভূমের মুরারই থানা তাদের এলাকার তিনজন বাসিন্দার যেসব নথি যোগাড় করেছে, তার মধ্যে আছে এদের আধার কার্ড, সরকারি হাসপাতালে ইমাম শেখের জন্মের সার্টিফিকেট, তিনজনের নামে স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের প্রশংসাপত্র, ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের প্রশংসাপত্র ইত্যাদি।

এছাড়া সুইটি বিবির দাদু বাবু শেখের একটি জমির দলিলও পাওয়া যায়, যেটি রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে।

আবার ঝাড়খন্ডের পাকুর জেলায় সুইটি বিবির পূর্বপুরুষরা যেখানে থাকতেন, সেখানকার পঞ্চায়েত প্রধানের সই করা একটি বংশ তালিকাও যোগাড় করেছে বীরভূমের পুলিশ।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যান পর্ষদের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম বুধবার তার এক্স হ্যান্ডেলে সুইটি বিবির দুই দাদু– জামিরুদ্দিন খান ও বাবু শেখের এবং সোনালি বিবির দাদুর বাবা মনখুস শেখের নামে থাকা জমির দলিল পোস্ট করেছেন। এই সব দলিল ৫০, ৬০ বা ৭০-এর দশকের।

সামিরুল ওই পোস্টে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ট্যাগ করে লিখেছেন, যাদের বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে, তাদের নাগরিকত্ব মাঠ পর্যায়ে এসে যাচাই করার জন্য দয়া করে যত দ্রুত সম্ভব একটা সংসদীয় কমিটি গঠন করুন। সারা দেশ প্রমাণ দেখুক যে এই নারীরা বাংলাদেশের নয়, তারা ভারতেরই।

বাংলাদেশ থেকে পাঠানো ভিডিও

যে দুটি পরিবারকে প্রত্যর্পন করা হয়েছে বাংলাদেশে, তাদের একটি ভিডিও এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেটি বাংলাদেশেই রেকর্ড করা হয়েছে, তবে নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি যে ওই ভিডিওটি ঠিক কোন জায়গায় রেকর্ড করা।

ভিডিওটি সামিরুল ইসলাম পোস্ট করেছেন তার এক্স হ্যান্ডেলে। ওই ভিডিওতে দুজন নারী, দুটি শিশু, একজন কিশোর এবং আরও এক পুরুষকে দেখা যাচ্ছে।

সেখানে এক নারীকে দিল্লি পুলিশের হাতে আটক হওয়ার সময় থেকে ঘটনাক্রমের বর্ণনা দিতে শোনা যাচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের প্রধান আসিফ ফারুক দাবি করেন, ওই নারী সুইটি বিবি। 

তিনি ওই ভিডিও বার্তায় বলেছেন, আমাদের দিল্লি থেকে ধরেছে.. আমরা কাজ করতে গিয়েছিলাম। আধার কার্ড দেখালাম, আমরা বাংলাদেশি নই।

তাও জবরদস্তি ওরা কি কি লিখিয়ে নিলে তোদেরকে বাংলাদেশি বানিয়ে দেবো, অভিযোগ করেন সুইটি বিবি।

তিনি এ-ও অভিযোগ করেন, প্রথমে রোহিনী অঞ্চলের থানায়, তারপরে একটি বাড়িতে চার দিন তাদের রাখা হয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যেই নানা কাগজপত্র বানানো হয়। তার অভিযোগ, তাদের ছবি ও হাতের ছাপ নেওয়া হয়, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শারীরিক পরীক্ষাও করানো হয়।

বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পরে তারা কার্যত এক কাপড়েই থাকছেন, মানুষের বাড়ির বারান্দায় মশার কামড় খেয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

ওই নারীর আবেদন, অনুরোধ করছি আমাদের এখান থেকে নিয়ে যান মমতা দিদি।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

এআইএস