তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে কেন বিজয়?
নিজ দলের রাজনৈতিক সমাবেশে পদদলনে ৪০ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর ভারতে ব্যাপক বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন দেশটির দক্ষিণী সিনেমার সুপারস্টার থেকে রাজনৈতিক নেতা বনে যাওয়া থালাপতি বিজয়।
শনিবার তামিলনাড়ুর কারুর জেলায় বিজয়ের আয়োজিত এক নির্বাচনী সমাবেশে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। এই অভিনেতার বক্তব্যের মাঝামাঝি সময়ের দিকে হঠাৎ করেই ভিড়ের মাঝে তীব্র ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। মর্মান্তিক এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশটিতে শুরু হয়েছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের রাজনীতি। সমাবেশে ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি কর্মকর্তারা পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করেনি বলে বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন।
বিজ্ঞাপন
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, বিজয়ের দল তামিলাগা ভেট্রি কাজহাগামের (টিভিকে) আয়োজকরা সমাবেশে জনতার এত বেশি উপস্থিতি সম্পর্কে কোনও ধারণাই করতে পারেননি এবং সেই অনুযায়ী যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেননি।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
• কে এই বিজয়?
৫১ বছর বয়সী বিজয় তামিলনাড়ুর অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা। যার অভিনয় জীবন কয়েক দশকজুড়ে বিস্তৃত। বছরের পর বছর ধরে তার অভিনিত সিনেমা বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। যে কারণে ভারতের সবচেয়ে ধনী তারকাদের একজন হয়ে উঠেছেন তিনি।
বিজয়ের পুরো নাম জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখর। তিনি চেন্নাইয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক পিতা ও গায়িকা মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় একাধিক সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি।
১৯৯২ সালে তার বাবার পরিচালিত নালাইয়া থীর্পু চলচ্চিত্রে প্রথম নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন বিজয়। ছবিটি দুর্নীতিগ্রস্ত এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কলেজ শিক্ষার্থীদের সংগ্রামের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি হলেও বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্ক্রল লিখেছে, এই চলচ্চিত্রই বিজয়ের ‘‘তামিলনাড়ুর সমস্যার সমাধানকারীর’’ ভাবমূর্তি গঠনের বীজ বপন করে দেয়।
পরে তিনি একাধিক রোমান্টিক ও কমেডি সিনেমায় অভিনয় করেন; যার বেশিরভাগই বক্স অফিসে সফল হয় এবং দর্শকদের কাছে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে চটপটে নাচের ভঙ্গির কারণে বিপুল ভক্তশ্রেণি তৈরি হয় তার।
বছরের পর বছর ধরে তিনি ঘিলি (২০০৪), পোক্কিরি (২০০৭), থুপ্পাক্কি (২০১২) এবং কাত্থির (২০১৪) মতো বহু সুপারহিট অ্যাকশন থ্রিলারে অভিনয় করেছেন। এসব সিনেমায় তার নায়িকাদের সঙ্গে সহজাত রসায়ন এবং ঠাণ্ডা মাথার অ্যাকশন দৃশ্য বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
ভক্তরা তাকে ‘‘ইলায়া থালাপাথি’’ বা ‘‘তরুণ সেনাপতি’’ নামে ডাকতে শুরু করেন। তামিল চলচ্চিত্রের বড় তারকাদের জন্য এ ধরনের ডাকনামের প্রচলন রয়েছে।
বিজয়ের নতুন কোনও সিনেমা মুক্তি পেলে ভক্তরা হলে গিয়ে ভিড় জমিয়ে উদযাপন এবং তাকে সমর্থন করেন। এমনকি গত কয়েক বছরে সমালোচকদের কাছ থেকে খারাপ রিভিউ পাওয়া বিস্ট (২০২২) এবং দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইমের (২০২৪) মতো সিনেমাও বক্স অফিসে দারুণ সফল হয়েছে।
বিস্টের সাফল্যের পর দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছিল, বিজয়ের তারকা খ্যাতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তার সবচেয়ে সাধারণ, প্রাণহীন এবং কৃত্রিমতায় ভরপুর থাকা সিনেমাও বৈশ্বিক বক্স অফিসে ২০০ কোটি রুপির (প্রায় ২২.৫ মিলিয়ন ডলার; ১৬.৭ মিলিয়ন পাউন্ড) বেশি আয় করেছে।
• রাজনীতিতে কেন বিজয়?
বিজয়ের রাজনীতিতে আসার গুঞ্জন বহু বছর ধরেই শোনা যাচ্ছিল। তার গঠন করা ফ্যান ক্লাব ২০২১ সালের স্থানীয় নির্বাচনে সন্তোষজনক জয় পেয়েছিল। এছাড়া সেই সময় তার দেওয়া বেশ কিছু বক্তব্যকে রাজনৈতিক ইঙ্গিতপূর্ণ বলেও ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।
তবে থালাপতি বিজয়ের হঠাৎ করে অভিনয় ছেড়ে দিয়ে পুরোদমে রাজনীতিতে নামার সিদ্ধান্ত ভক্তদের অবাক করে। তিনি বলেছেন, আগামী বছর মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘জানা নায়াগান’’ হতে যাচ্ছে তার শেষ চলচ্চিত্র।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে চলচ্চিত্র তারকাদের রাজনীতিতে আসাটা একেবারে সাধারণ ঘটনা। জনপ্রিয়তা আর ব্যাপক ভক্তশ্রেণিকে নির্বাচনী মাঠে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন তারা।
তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ এমজি রামাচন্দ্রন। যিনি এমজিআর নামে ব্যাপক জনপ্রিয়। ১৯৬২ সালে তারকা খ্যাতির শীর্ষে থাকা অবস্থায় রাজ্যের শাসক দল দ্রাবিড়া মুন্নেত্র কাজহাগামে (ডিএমকে) যোগ দেন তিনি।
১৯৭২ সালে ডিএমকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড়া মুন্নেত্র কাজহাগাম (এআইএডিএমকে) নামের নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এমজি রামাচন্দ্রন।
এমজিআরের সবচেয়ে জনপ্রিয় সহ-অভিনেত্রী জে জয়ললিতা তার পথ অনুসরণ করে এআইএডিএমকেতে যোগ দেন। এমনকি এমজিআরের মৃত্যুর পর দলটির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জয়ললিতা। এরপর ছয় মেয়াদে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জয়ললিতা।
তবে চেন্নাইয়ের সকল চলচ্চিত্র তারকার রাজনৈতিক যাত্রা সফল হয়নি। দক্ষিণ ভারতের কিংবদন্তি অভিনেতা কমল হাসান। ভারতের বিভিন্ন ভাষার ২০০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১৮ সালে মাক্কাল নিধি মাইয়াম (এমএনএম) নামের রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি। রাজ্যে ডিএমকে এবং এআইএডিএমকের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোই তার রাজনৈতিক লক্ষ্য বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার দল কোনও সংসদীয় কিংবা বিধানসভার আসনে জয়ী হতে পারেনি।
তামিল সিনেমার আরেক সুপারস্টার রজনীকান্ত বহু বছর রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেও ২০২০ সালে আর রাজনীতিতে আসবেন না বলে ঘোষণা দেন। সমালোচকরা বলেছেন, বিপুল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও এসব তারকা-নেতৃত্বাধীন দল প্রায়ই তৃণমূল পর্যায়ে অভিজ্ঞতার অভাবে সাফল্য পেতে ব্যর্থ হয়।
গত বছর দল গঠনের পর থেকে বিজয়ের সমাবেশগুলোতে বিপুল জনসমাগম দেখা গেছে। তাকে এক ঝলক দেখা এবং সেলফি তোলার জন্য হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বীরা তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং কিছু বক্তব্যকে অস্পষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছেন।
• এরপর কী হতে পারে?
ভারতে প্রায়ই রাজনৈতিক সমাবেশে পদদলনের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে আয়োজক ও কর্তৃপক্ষের মাঝে পাল্টাপাল্টি দোষারোপও চলে। বিজয়ের সমাবেশে ঘটে যাওয়ার দুর্ঘটনার বিষয়ে ভক্তরা অভিযোগ করে বলেছেন, নিরাপদ ভেন্যুতে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তবে রাজ্য কর্মকর্তারা বিবিসি তামিলকে বলেছেন, বিজয়ের দলের পছন্দেই ভেন্যুর অনুমোদন করা হয়েছে।
দেশটির কিছু মহল থেকে বিজয়কে গ্রেপ্তারের দাবি উঠেছে। তবে বিপুল জনপ্রিয়তা বিবেচনায় ডিএমকে নেতৃত্বাধীন তামিলনাড়ু সরকার এই বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
এই দুর্ঘটনার কারণ জানতে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্টালিন কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করেছেন।
এদিকে, বিজয়ের রাজনৈতিক দল টিভিকে মাদ্রাজ হাইকোর্টে মামলা করেছে এবং দুর্ঘটনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এই মামলার বিষয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টে আগামী সোমবার শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
পদদলনে হতাহতের শিকার ব্যক্তিদের এখন পর্যন্ত দেখতে যাননি বিজয়; যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। এক বিবৃতিতে বিজয় বলেছেন, এই দুর্ঘটনায় তিনি ‘‘ভেঙে পড়েছেন’’ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা তার জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষায় কোনও প্রভাব ফেলবে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
সূত্র: বিবিসি।
এসএস