বাংলাদেশে চীনের তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্প নিয়ে ভারতের সমস্যা কী?
আর কোনো বিলম্ব ছাড়া চীনের সহায়তায় বাংলাদেশে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জোরালো হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে ১০০ কিলোমিটারজুড়ে মশাল প্রজ্বলন এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ নিয়ে মানববন্ধন হয়েছে।
ধারণা করা হয় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে কৃষির বিপ্লব ঘটবে।
বিজ্ঞাপন
সাধারণ মানুষ তিস্তা মহাপরিকল্পনার জন্য যে এক হচ্ছেন এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে থাকা নদী চুক্তিগুলো নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ। যার মূলে রয়েছে তিস্তা নদী।
৪১৪ কিলোমিটার বিস্তৃত এ আন্তর্জাতিক জলধারা শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সেচের উৎস-ই নয়, এটি গত কয়েক বছর ধরে ভূ-রাজনৈতিক হটস্পটে পরিণত হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
তিস্তা নদী কেন গুরুত্বপূর্ণ?
তিস্তা নদীর উৎপত্তি হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলের পাউহুনরি পর্বতে। এটি বয়ে গেছে ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে। এরপর নদীটি রংপুর বিভাগ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর যমুনা নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে চলে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশ তিস্তা নদীকে সেচ ও কৃষির জন্য ব্যবহার করে। কিন্তু পানি স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশের ছয় বিভাগের লাখ লাখ কৃষক ঠিকভাবে ফসল উৎপাদন করতে পারেন না।
আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, নদীর শুষ্কতার কারণে প্রতিবছর ১৫ লাখ টন চাল উৎপাদন হয় না।
অপরদিকে ভারত গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। দেশটির পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা নদী সেচের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে তারা এ নদী ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করে।
দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব
ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৫৪টি নদী। কিন্তু তিস্তা নদীর ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে।
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে একটি অস্থায়ী পানিবন্টন চুক্তি হয়। এতে বলা হয় তিস্তার ৩৯ শতাংশ পানি ভারত আর ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। কিন্তু এ চুক্তি কার্যকর হয়নি। ২০১১ সালে কূটনৈতি তৎপরতা এ নদী নিয়ে দীর্ঘ দ্বন্দ্ব অবসানের একটি আশা তৈরি করেছিল। ওই সময় বলা হয়েছিল শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার ৩৭ শতাংশ পানি বাংলাদেশ পাবে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কারণে চুক্তিটি আর হয়নি। তিনি দাবি করেন, এমন চুক্তি হলে তার রাজ্যের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরপর থেকে তিস্তা নিয়ে আলোচনা পুরোপুরি থমকে আছে।
এরপর এ নিয়ে ভারতের কেন্দ্র সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় বাংলাদেশ ভাবতে শুরু করে ভারত সরকার তিস্তা নিয়ে কিছু করতে আর সক্ষম নয় অথবা তারা কিছু করতে চায় ও না।
কেন চীনের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ
সাধারণ মানুষের চাপ ও ভারতের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায়, বাংলাদেশ তিস্তা নিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকেছে।
২০২৫ সালের মার্চে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে যান। সেখানে তিনি পানি ব্যবস্থাপনায় চীনকে মাস্টার হিসেবে অভিহিত করেন। এছাড়া চীনের কাছ থেকে তিনি ৫০ বছরের একটি মহাপরিকল্পনাও পান। যেখানে তিস্তাকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
চীন এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহযোগী হিসেবে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ ও সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দুই দেশের এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ চীনা কোম্পানিগুলোকে তিস্তা নদী ব্যাপক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প (টিআরসিএমআরপি), জলাধার উন্নয়ন, নদীর তলদেশ খনন, সড়ক এবং স্যাটেলাইট শহর প্রকল্পে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এছাড়া দুই দেশ ইয়ারলুং জানবো-যমুনা নদীর জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি দেয়। এই নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাদের শঙ্কা, নদী সম্পদের ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ নিম্নধারায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এরসঙ্গে চীন বাংলাদেশের মোংলা বন্দর, চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিভিন্ন শিল্পে অর্থায়ন করছে। যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সহযোগিতাকে আরও কার্যকর করছে।
ভারতের জন্য ঝুঁকি
ভারতের জন্য এ বিষয়টি শুধুমাত্র পানি নয়, তারা বিষয়টিকে ভূ-রাজনৈতিক ঘেরাও হিসেবেও বিবেচনা করে।
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প সিলিগুঁড়ি করিডর বা চিকেন নেকের কাছে অবস্থিত। ৬০ কিলোমিটার লম্বা ও ২২ কিলোমিটার প্রস্থের এই সরু ভূখণ্ডটি ভারতের মূল অংশকে তাদের সেভেন সিস্টার রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
এটির কাছে অন্য কোনো বিদেশি শক্তিকে ভারত নিজেদের নিরাপত্তার ঝুঁকি হিসেবে দেখে।
এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি নিয়েও ভারত উদ্বিগ্ন। এ ঘাঁটি তিস্তা প্রকল্পের কাছে অবস্থিত। সেখানে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যস্ততা বেড়েছে। ভারতের অভিযোগ সেখানে চীনের উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভারতের ধারণা, চীনারা যদি এ বিমানঘাঁটির কাছে কার্যক্রম চালানোর সুযোগ পায় এটি ভারতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। কারণ এরমাধ্যমে তাদের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং সামরিক চলাফেরার ওপর নজরদারি চালাতে পারবে বেইজিং।
এরমধ্যে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর উপরের দিকে একটি মেগা বাঁধ তৈরি করছে চীন। এর জেরে ভারত সরকার কিছু পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশে বিক্ষোভ হওয়ার সময়টি চমকের কিছু নয়। কারণ বাংলাদেশ এখন জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থের কাছে নতি স্বীকার করলেও বিএনপি এই তিস্তা ইস্যুতে নিজেদের শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।
এছাড়া বাংলাদেশ-ভারতের ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ আগামী বছর শেষ হয়ে যাওয়ার কারণেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জোর দাবি উঠেছে।
সূত্র: দ্য উইক
এমটিআই