শতাব্দীর ভয়াবহতম মহামারি থেকে মুক্তির চেষ্টায় মরিয়া বিশ্বের প্রায় সকল দেশ। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় টিকা পেতে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তিও করছে দেশগুলো। ব্লুমবার্গের করোনা ট্র্যাকার বলছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে প্রায় সাড়ে ৮০০ কোটি ডোজ করোনা টিকার চুক্তি হয়েছে।

চলমান করোনা মহামারির কারণে সবার কাছে টিকা এখন সোনার হরিণ। এখন পর্যন্ত বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান করোনার টিকা আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট ফাইজার ও জার্মানির বায়োটেক কোম্পানি বায়োএনটেক, আরেক মার্কিন কোম্পানি মডার্না, ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাকের করোনাভ্যাক এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি কোভিশিল্ড টিকা প্রয়োজনীয় অনুমোদনের পর বাজারে এসেছে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত কোভিড টিকা ‘কোভিশিল্ড’ উৎপাদনে দিনরাত পরিশ্রম করেন সেরাম ইনস্টিটিউটের গবেষক, বিজ্ঞানীরা। অবশেষে টিকা দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত হয় কোভিশিল্ড।

এটা সবার জন্যই ভালো লাগার বিষয় হলেও বাঙালীদের জন্য একটু বেশিই গর্বের। কারণ এই কোভিশিল্ড টিকা আবিষ্কারের নেপথ্যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাজ করেছেন এক বাঙালী বিজ্ঞানী।

আলোচিত এই বিজ্ঞানীর নাম ড. স্বপন জানা। তিনি সেরাম ইনস্টিটিউটের করোনা টিকা উৎপাদন প্রকল্পের অন্যতম সদস্য।

ভারতের কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ড. স্বপন। বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৮৫-১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করেন তিনি।

স্বপন জানাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক দীপঙ্কর হালদার। ড. স্বপন জানার অর্জনে তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত।

তিনি বলেন,‘কলকাতায় আসলেই স্বপন জানা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তিনি কীভাবে কাজ করেন, এটা জানতাম। তিনি যে পরিমাণ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন তা দূর থেকেই অনুধাবন করতে পারতাম।’

অবশ্য করোনার টিকা আবিষ্কারই যে ২০২০ সালে ড. স্বপন জানার একমাত্র অর্জন, তা নয়। টিকা আবিষ্কারের পাশাপাশি নয়, অন্যত্রও তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর নিউমোকোকাল কনজুগেট ভ্যাকসিন উদ্বোধন করে সেরাম ইন্সটিটিউট। ‘নিউমোকোকাল পলিস্যাকারাইড কনজুগেট ভ্যাকসিন’ (পিপিএসভি২৩) নামক এই টিকা নিউমোনিয়ার পাশাপাশি ফুসফুসের ২৩ রকমের নিউমোকোকাল সংক্রমণ আটকাতে সক্ষম।

২০১৩ সালের ট্রায়াল থেকে ২০২০ সালে টিকা চূড়ান্তভাবে চালু পর্যন্ত এই প্রজেক্টটির নেতৃত্ব দেন ড. স্বপন জানা। সুলভমূল্যের এই টিকা সাড়া ফেলে দিয়েছিল চিকিৎসা জগতে। এমনকি বিল গেটস এই কাজের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ভারত অনায়াসেই করোনা টিকা প্রস্তুত করতে পারে।

অধ্যাপক দীপঙ্কর হালদার বলেন,‘এই করোনা পরিস্থিতিতে কাজের জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড অ্যান্ড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তিনজন সদ্য পাস করা ছাত্রকে ডেকে নেন ড. স্বপন। তারাও রাতদিন জেগে পরিশ্রম করেছে। ওরাও আমাদের অহংকার।’

ড. স্বপন জানার এই অর্জনের খবরে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সেই উচ্ছ্বাস প্রকাশও করা হয়।

বিশ্ববিদ্য়ালয় কতৃপক্ষ লেখে, ‘অ্যাস্ট্রোজেনেকার সঙ্গে যৌথভাবে ভ্যাকসিন তৈরি করল সেরাম ইনস্টিটিউট। সেই টিকা এখন সরবরাহও শুরু হয়েছে। সেরাম ইনস্টিটিউটকে আমাদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।’

বিশ্ববিদ্যালয়টি আরও লেখে, ‘আমরা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী স্বপন জানার কথা। ভ্যাকসিনটি উৎপাদনের সঙ্গে শুরু থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় আশা করে, এমন একজন করোনাযোদ্ধার চলার পথ তাদের পাথেয় হবে।’

এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে কলকাতায় পৌঁছায় কোভিশিল্ড টিকা। মহারাষ্ট্রের পুনে থেকে বিশেষ বিমানে এটি কলকাতায় আসে। প্রথম দফায় ৬ লাখ ৮৯ হাজার জনকে টিকা দেওয়া যাবে।

টিকার একটি অংশ কলকাতার বাগবাজারের কেন্দ্রীয় মেডিকেল স্টোরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে বিভিন্ন জেলায় তা পাঠানো হবে।

অন্য অংশটি নেওয়া হবে কলকাতার হেস্টিংসে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের মেডিকেল স্টোরে। সেখান থেকে এই টিকা পাঠানো হবে আসাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়সহ দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে।

আগামী ১৬ জানুয়ারি (শনিবার) থেকে কলকাতাসহ সমগ্র ভারতজুড়ে শুরু হবে করোনার টিকাদান কর্মসূচি।

টিএম