মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দের এই ছবিটি সম্প্রতি প্রকাশ করে তালেবান

মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে প্রধান করে আফগানিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘোষণা করেছে তালেবান। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এই ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে আফগানিস্তানকে ইসলামিক আমিরাত হিসেবেও ঘোষণা করেছে তারা।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, আফগানিস্তানে গঠন করা নতুন মন্ত্রিসভায় কোনো নারী স্থান পাননি। মন্ত্রিসভায় এমন সব জ্যেষ্ঠ ও কট্টরপন্থি তালেবান নেতাদেরকে স্থান দেওয়া হয়েছে, যারা গত দুই দশক ধরে দেশটিতে মার্কিন বাহিনীর ওপর জঘন্য সব হামলা পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত।

আফগানিস্তানের নতুন সরকারপ্রধান মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ জাতিসংঘের কালো তালিকায় রয়েছেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া সিরাজউদ্দিন হাক্কানি যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছেন। হাক্কানির মাথার জন্য ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার বহু আগেই ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

আগস্ট মাসের মাত্র ১০ দিনে যেভাবে তালেবান পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তা অনেককে অবাক করে দিয়েছে। এর প্রায় তিন সপ্তাহ পর আফগানিস্তানকে ‘ইসলামিক আমিরাত’ ঘোষণা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করেছে তালেবান।

নতুন তালেবান সরকারে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এখানে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো:

১. হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা
২০১৬ সালের মে মাস থেকে তালেবানের ‘সুপ্রিম লিডার’ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা। তালেবান ঘোষিত তথাকথিত ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের তিনি শীর্ষ নেতা। আশির দশকে তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন।

তবে সামরিক কমান্ডারের তুলনায় একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবেই তার পরিচিতি বেশি। নব্বইয়ের দশকে শরিয়া আদালতের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন আখুন্দজাদা। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর তালেবান ধর্মীয় আইনকানুন চালু করে। সেই সময় হত্যাকারী ও ব্যভিচারীদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো এবং চোরদের হাত কেটে ফেলা হতো।

তখনকার তালেবান নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের (ধারণা করা হয় তিনি ২০১৩ সালে মারা গেছেন) নেতৃত্বে তালেবান টেলিভিশন, সংগীত, চলচ্চিত্র নারীদের মেকআপ বা রূপসজ্জার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ১০ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়াও তারা নিষিদ্ধ করেছিল।

হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার বয়স আনুমানিক ৬০ বছর বলে ধারণা করা হয়। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি আফগানিস্তানে কাটিয়েছেন। তবে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতে, তিনি তথাকথিত ‘কোয়েটা শুরা’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে আসছেন। পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থান করেন এমন আফগান তালেবান নেতাদের কোয়েটা শুরুর সদস্য বলে মনে করা হয়।

তালেবানের সুপ্রিম লিডার হিসাবে তিনি রাজনৈতিক, সামরিক এবং ধর্মীয় সব বিষয়ের শীর্ষ নেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

২. প্রধানমন্ত্রী: মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ
১৯৯৪ সালে যে চারজন মিলে আফগানিস্তানে তালেবান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মোল্লাহ মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ তাদের একজন। তিনি সবচেয়ে বেশিদিন ধরে তালেবানের নেতাদের কাউন্সিল বা রেহবারি শুরার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১৯৯৬-২০০১ সালে তালেবানের প্রথম দফার দায়িত্ব পালনের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ওই সময়ে তালেবান সরকারে দায়িত্ব পালন করার কারণে তার ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

৩. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: সিরাজউদ্দিন হাক্কানি
এই গ্রুপের আরেকজন শীর্ষ নেতা হচ্ছেন সিরাজউদ্দিন হাক্কানি, যিনি এফবিআইয়ের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় রয়েছেন। পিতা জালালউদ্দিন হাক্কানির মৃত্যুর পর তিনি হাক্কানি নেটওয়ার্কের নতুন নেতা হন। আফগানিস্তানে আফগান বাহিনী এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ কিছু হামলার জন্য তাকে দায়ী করা হয়।

ধারণা করা হয়, তার বয়স ৪৫ বছর। হাক্কানি নেটওয়ার্ক হচ্ছে ওই এলাকার সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ভীতিকর জঙ্গি গ্রুপ। অনেকে মনে করেন, আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেট গ্রুপের চেয়ে তারা বেশি প্রভাবশালী। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় থাকা এই গ্রুপটি আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে তালেবানের আর্থিক ও সামরিক সম্পদের তত্ত্বাবধান করে থাকে।

দোহার শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের আগে নিউইয়র্ক পোস্টে ছাপা হওয়া একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে সিরাজউদ্দিন হাক্কানি লিখেছেন, ‘চার দশকের বেশি সময় ধরে প্রতিদিন অমূল্য আফগান জীবন ঝরে যাচ্ছে। প্রত্যেকে এমন কাউকে হারিয়েছে যাকে তারা ভালোবাসতো। যুদ্ধে সবাই ক্লান্ত। আমি উপলব্ধি করতে পারছি, পরস্পরকে হত্যা বা আহত করা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’

৪. উপ-প্রধানমন্ত্রী: আবদুল গনি বারাদার
মোল্লা আবদুল গনি বারাদার তালেবানের একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর অভিযানে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি তাদের একজন প্রধান ব্যক্তিতে পরিণত হন। তবে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের যৌথ অভিযানে তিনি করাচি থেকে গ্রেফতার হন।

পরবর্তী আট বছর ধরে তিনি কারাগারে বন্দী থাকেন। দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে কাতারের দোহায় চালু করা তালেবানের রাজনৈতিক দফতরের প্রধান হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

কোনো তালেবান নেতা হিসাবে ২০২০ সালে তিনিই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তার ঠিক আগে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের দোহা চুক্তিতে তালেবানের পক্ষে স্বাক্ষর করেন বারাদার।

তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল তিনি নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে দেখা গেল তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বারাদার ছাড়াও এই অন্তর্বর্তী সরকারে আরও একজন উপ-প্রধানমন্ত্রী আছেন। তিনি হচ্ছেন- মৌলভি আবদুল সালাম হানাফি।

৫. প্রতিরক্ষামন্ত্রী: মোহাম্মদ ইয়াকুব
তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের সন্তান হচ্ছেন মোহাম্মদ ইয়াকুব। ধারণা করা হয়, তার বয়স ত্রিশ বছরের কিছু বেশি। তিনি বর্তমানে দলের সামরিক শাখার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

২০১৬ সালে তখনকার তালেবান নেতা আখতার মানসুর নিহত হওয়ার পর তালেবানের একটি অংশ ইয়াকুবকে তালেবানের সুপ্রিম লিডার হিসাবে মনোনীত করতে চান। তবে অন্যরা মনে করেছেন, সেই দায়িত্ব পালনে তার বয়স কম এবং অনভিজ্ঞ।

বার্তাসংস্থা এপির তথ্য অনুযায়ী, তালেবান যখন পুরো আফগানিস্তান জুড়ে নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছিল, ইয়াকুব তালেবান যোদ্ধাদের আহ্বান জানিয়েছেন যেন তারা আফগান সামরিক বাহিনী বা সরকারের কর্মকর্তাদের কোনো ক্ষতি না করে। সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর লুটতরাজ করা না হয়, সেই নির্দেশও দিয়েছিলেন।

তালেবানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আরও রয়েছেন:

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভি আমির খান মুত্তাকি, অর্থমন্ত্রী মোল্লাহ হিদায়াত বদ্রি, বিচারমন্ত্রী আবদুল হাকিম ইশাকজি, তথ্যমন্ত্রী খাইরুল্লাহ সাইদউয়ালি খয়েরখা

টিএম