ট্রাম্পের বিদায়ে ইরান কী হামলার হাত থেকে বেঁচে গেল?
গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু দেশের তালিকায় বেশ উপরের দিকেই রয়েছে ইরানের নাম। চির বৈরি এই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে, আবার কমেও। কিন্তু ট্রাম্পের শাসনামলে ওয়াশিংটন-তেহরানের সম্পর্ক যে অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল, তাতে কেবল বাকিই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের হামলা আর উভয়পক্ষের জন্য বিপর্যয়কর যুদ্ধ। তবে হয়-হচ্ছে করেও জল আর সেদিকে গড়ায়নি।
আর এতে ইরান বেশ স্বস্তিই পেয়েছে। কারণ ক্ষমতার শেষভাগে এসে ইরানের ওপর হামলা করে বসতে পারেন ট্রাম্প- এমন গুঞ্জন শোনা গেলেও বাস্তবে আর তেমনটি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প শাসনামলের সমাপ্তির ফলে ইরান সতর্কতার সঙ্গে হলেও এক ধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।
বিজ্ঞাপন
উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শেষ দিনগুলোতে তিনি হয়তো ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ’ তৈরি করবেন। শুধু তাই নয় ইরানের বেসামরিক পরমাণু কেন্দ্র এবং অন্যান্য জায়গাতেও তিনি হামলা চালাতে পারেন বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
বিবিসি বলছে, গত নভেম্বর মাসে ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া বিভিন্ন খবরে এ ধরনের ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছিল যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়তো সামরিক পথ বেছে নিতে পারেন। এ বিষয়ে তিনি তার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টাদের মতামতও জানতে চেয়েছিলেন।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তিনি ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পক্ষের যে পরমাণু চুক্তি হয়েছিল তাতে আমেরিকাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।
সেরকম হলে ইরানের ওপর আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং চুক্তি মেনে চলার শর্তে ইরানকে তখন অর্থও দিতে হবে।
তাহলে কি বলা যায় যে ইরান এখন হামলার হাত থেকে বেঁচে গেছে? এক কথায় বললে, না। ইরান নিয়ে ইসরায়েল এখনও প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন। ইরানের বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচিই শুধু নয়, তেহরানের পরমাণু অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির চেষ্টাও তাদের উদ্বেগের কারণ।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েলকে সামরিক বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এজন্য সম্পদ ও বিনিয়োগের প্রয়োজন এবং তার জন্য আমি কাজ করছি।’
ইহুদি এই দেশটি মনে করে ইরানের হাতে যদি পরমাণু অস্ত্র চলে আসে সেটা তাদের অস্তিত্বের জন্যই বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে দেরি না করে ইরানকে এখনই থামাতে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।
ইরান সবসময়ই বলে আসছে তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ কাজে জ্বালানি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। তবে সম্প্রতি দেশটি যে হারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে সেটি ২০১৫ সালের চুক্তিকে লঙ্ঘন করছে এবং তা নিয়েই নতুন করে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
এর আগে ১৯৮১ সালে ইসরায়েল সন্দেহ করেছিল যে ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন পরমাণু অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছেন। পরে 'অপারেশন ব্যাবিলন' নামের অভিযানে এফ ফিফটিন ও এফ সিক্সটিন যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালিয়ে ইরাকের অসিরাক পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
এর ২৬ বছর পর ২০০৭ সালে ইসরায়েল সিরিয়াতেও অভিযান চালিয়েছিল। যার নাম ছিল অপারেশন আউটসাইড দ্য বক্স। ওই অভিযানে তারা দেইর আল-জুরের কাছে মরুভূমিতে স্থাপিত গোপন একটি প্লুটোনিয়াম চুল্লি ধ্বংস করে দিয়েছিল সেটি চালু করার আগেই।
কিন্তু ইরান আক্রমণের জন্য খুব একটা সহজ টার্গেট নয়। প্রথমত দূরত্ব, সেখানে পৌঁছানো এবং তার পর দেশটির শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া ইসরায়েল সেখানে কতোটা সফলভাবে আক্রমণ করতে পারবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এছাড়াও বাইডেন প্রশাসন এধরনের হামলায় অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক।
যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং কোন উপসাগরীয় আরব দেশ থেকে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালানো হতে পারে এই আশঙ্কায় তেহরান তাদের কিছু কিছু কেন্দ্র পাহাড়ের তলায় মাটির নিচে লুকিয়ে ফেলার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করেছে এবং এবিষয়ে তারা অনেক কাজও করেছে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সামরিক ও নিরাপত্তা কাঠামোর সাথে জড়িত। তাছাড়া এ ধরনের হামলার ব্যাপারে ইরান এতো দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে যে এখন মাটির নিচে তৈরি করা এসব স্থাপনা টার্গেটও করাও ইসরায়েলের জন্য বেশ কঠিন হবে। তা সত্ত্বেও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা তিনটি দিক থেকে হামলার শিকার হতে পারে।
শারীরিক হামলা
ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) গবেষক ও অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মার্ক ফিৎসপ্যাট্রিক বলেন, ‘ইরানের স্থাপনাগুলো অজেয় নয়।’
‘নাতাঞ্জে যে স্থাপনাটি আছে সেখানে বাঙ্কার ধংস করে দেওয়ার বোমা দিয়ে নিখুঁতভাবে হামলা চালানো যেতে পারে। এজন্য হয়তো দুটো নিখুঁত আঘাতের দরকার: প্রথম আঘাতে একটা বড় গর্ত তৈরি হবে এবং পরের হামলায় এর ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে স্পর্শকাতর সব যন্ত্রপাতি এমনভাবে নাড়িয়ে দেওয়া হবে যে সেগুলো আর কাজ করতে পারবে না।’
তবে ইরান অনেক বড় একটি দেশ এবং তার পারমাণবিক স্থাপনা বিভিন্ন জায়গায় ভূগর্ভে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
প্রায় আট বছর আগে ২০১২ সালে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ফর্দোতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের স্থাপনাটি একটি পর্বতের অন্তত ২৬০ ফুট গভীরে। যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত শক্তিশালী বাঙ্কার-বাস্টিং বোমা দিয়ে নিখুঁতভাবে হামলা চালিয়েও এটি হয়তো ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
মার্ক ফিৎসপ্যাট্রিক বলেন, ‘ফর্দো স্থাপনাটি মাটির এতো গভীরে যে সেটি বাঙ্কার-বাস্টার প্রতিরোধ করতে পারবে। কিন্তু কোন নাশকতা তো তারা ঠেকাতে পারবে না। এর প্রবেশ মুখ এবং ভেতরে ঢোকার পথে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে স্থাপনাটি কয়েক মাসের জন্য অকেজো করে দেওয়া যায়।’
তবে এধরনের স্থাপনায় পৌঁছাতে হলে সম্ভবত দুই দফায় হামলা চালাতে হবে। প্রথমে ইরানের আকাশ সীমায় ঢুকে পড়তে হবে। সেটা করতে হবে ইরানকে লুকিয়ে অথবা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়ে।
ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার ব্যাপারে ইরান প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। দেশটির রয়েছে বাভার-৩৭৩। এটি রাশিয়ার এস-৩০০ প্রতিরোধী ব্যবস্থার মতো। এই ব্যবস্থা ৩০০ কিলোমিটার দূরের কোন বিমান চিহ্নিত করে সেটিকে মাটিতে নামিয়ে দিতে পারে।
মানুষ দিয়ে আক্রমণ
এধরনের হামলা ইতোমধ্যেই চালানো হয়েছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের ভেতরে গুপ্তচরদের ব্যতিক্রমী ও অত্যন্ত শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
তাদের কাছে এতোটাই তথ্য আছে যে ইরানের শীর্ষস্থানীয় একজন বিজ্ঞানী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন ফখরিজাদেহকে গত ২৭ নভেম্বর হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। হামলাকারীরা নিখুঁতভাবে জানতো তিনি কোন সময়ে কোন পথ ধরে যাচ্ছেন।
সেদিন তার ওপর কিভাবে হামলা চালানো হয়েছিল সেবিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন খবর পাওয়া গেছে।
ইরান দাবি করছে, একটি রিমোট স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত মেশিনগান দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এটি একটি পিক-আপ ট্রাকের ওপর বসানো ছিল। অন্য সূত্রের বিশ্বাস, মোসাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গুপ্তচর তার ওপর হামলা চালিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেছে।
তবে যেভাবেই হোক, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জনক হিসেবে পরিচিত এবং গোপনে পরমাণু কর্মসূচি চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা যাকে দায়ী করে সেই ফখরিজাদেহকে হত্যা করা হয়েছে।
এই হামলার নেপথ্যে কারা আছে সেবিষয়ে ইসরায়েল কোনো মন্তব্য করেনি।
এই হত্যাকাণ্ডের আগে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ইরানে চারজন শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানীকে ইরানের ভেতরে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়েছে গাড়ি-বোমা ফাটিয়ে।
এসব ঘটনায় নিজেদের জড়িত থাকার বিষয়ে ইসরায়েল কখনও মন্তব্য করেনি, আবার কখনও অস্বীকারও করেনি। তবে এসব হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে ইরানের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা সত্ত্বেও হত্যাকারীরা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে।
সাইবার হামলা
সাইবার জগতেও অঘোষিত এক যুদ্ধ চলছে, যার একদিকে ইরান আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরব।
ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে মূলত সেন্ট্রিফিউজ সমৃদ্ধ করা হয়। সেখানকার কম্পিউটারে ২০১০ সালে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এক ভাইরাস বা ম্যালাওয়্যার দিয়ে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। ওই ভাইরাসের কোডনেম ছিল স্টাক্সনেট।
এর ফলাফল ছিল বিশৃঙ্খলা, সেন্ট্রিফিউজগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ঘুরতে থাকে এবং তার ফলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ কয়েক বছর পিছিয়ে যায়।
ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে বলে খবরে ফলাও করে বলা হলেও ধারণা করা হয়, স্টাক্সনেট তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞরা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন।
সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা হামলা চালায় ইরান। নিজেদের তৈরি ম্যালাওয়্যার দিয়ে ইরান সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সৌদি আরমকোর নেটওয়ার্কের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। এর ফলে ৩০ হাজার কম্পিউটার অচল হয়ে পড়ে এবং সৌদি আরবের তেল উৎপাদনও হুমকির মুখে পড়ে যায়।
ইরানের তৈরি ওই ভাইরাসটির নাম ছিল শামুন। এরপরেও এধরনের হামলা অব্যাহত থেকেছে।
ইরান ও বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে তেহরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, এর ফলে প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে আর ইরানে সামরিক হামলার কথা বিবেচনা করতে হবে না।
কিন্তু এই চুক্তির ব্যাপারে ইসরায়েল এবং সৌদি আরব সবসময় সন্দিহান ছিল। তারা মনে করতো এই চুক্তি অনেক বেশি নমনীয় ও সাময়িক। কারণ এই চুক্তিতে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়নি।
এখনও তারা চায় না জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর এনিয়ে তাদের উদ্বেগ দূর না করেই এই চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা হোক।
উপসাগরীয় এলাকার কোনো দেশই আর যুদ্ধ দেখতে চায় না। এমনকি ২০১৯ সালে সৌদি আরবে তেলের অবকাঠামোর ওপর যে চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করা হয়।
কিন্তু ইরান গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই সন্দেহ যতদিন থাকবে ততদিন তাদের স্থাপনার ওপর সামরিক আক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাবে।
টিএম