‘নতুন’ মধ্যপ্রাচ্যে অগ্নিপরীক্ষার সামনে জো বাইডেন
‘বন্ধুগণ, এখন সময় পরীক্ষার’ - গত ২০ জানুয়ারি অভিষেক উপলক্ষে দেয়া ভাষণে তার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো একেক করে বলতে গিয়ে যে সাবধান-বাণী উচ্চারণ করেছিলেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, সেই পরীক্ষার সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নগুলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
কারণ, বর্তমান বাইডেন প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি এবং এ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্ব তাদের অনেকেই ওবামা সরকারে ছিলেন। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের যেসব সমস্যার সমাধান তারা দিয়ে যেতে পারেননি, সেগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে তারা দেখতে পাবেন, গত চার বছরে বাস্তবতা অনেক বদলে গেছে।
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে বড় ধাক্কা তারা খাবেন যখন দেখবেন যেসব নীতি তারাই প্রণয়ন করেছিলেন, তার অনেকগুলোও উধাও হয়ে গেছে বা জটিল চেহারা নিয়েছে। কিন্তু অনেক আবার মনে করছেন, নতুন এই বাস্তবতার মধ্যে সুযোগও তৈরি হয়েছে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে ধাক্কা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা হলো ওবামা প্রশাসনে থাকাকালে যেসব নীতি তারা প্রণয়ন করেছিলেন, তার অনেকগুলোই উধাও হয়ে গেছে কিংবা জটিল রূপ নিয়েছে। যদিও তাদের অনেকেই আবার মনে করছেন, নতুন এই বাস্তবতার মধ্যে কিছু নতুন সুযোগও তৈরি হয়েছে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা প্রতিষ্ঠান কার্নেগী এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের গবেষক কিম গ্যাটাস এ সম্পর্কে বলেন,‘নতুন প্রশাসনের লোকজন বুঝতে পারছেন যে মধ্যপ্রাচ্যে ওবামা সরকারের নীতিতে গলদ কোথায় ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাইডেনের প্রশাসন হয়তো নতুন পথে হাঁটবেন, কারণ তারা অতীতে তাদের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। তাছাড়া, চার বছর আগের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য এখন অনেকটাই ভিন্ন।’
বিদেশনীতিতে সবার আগে ইরান
আমেরিকার নতুন প্রশাসনের বিদেশ নীতির ফাইলে প্রথমেই রয়েছে ইরান। এর প্রধান কারণ, ২০১৫ সালে ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখতে ওবামা প্রশাসনের উদ্যোগে বহুপাক্ষিক যে ঐতিহাসিক চুক্তি হয়েছিল; ডোনাল্ড ট্রাম্প তা থেকে আমেরিকাকে বের করে আনার পর চুক্তিটি এখন সুতোয় ঝুলছে। যে কোনো সময় ছিঁড়ে পড়তে পারে।
সেই সঙ্গে ইয়েমেনে চলমান রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা বাইডেন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য, যদিও ইরানের সঙ্গে চুক্তির ফলে ক্ষুব্ধ সৌদি আরবকে শান্ত করতে বারাক ওবামা শুরুর দিকে ইয়েমেন যুদ্ধ সমর্থন করেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তার প্রথম বিদেশ সফরে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। সে সফরে তিনি ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেন যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রয় চুক্তি।
তখন থেকেই সৌদি আরবের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নাতীত আনুকূল্য এবং ইরানকে যতটা সম্ভব চাপে রাখার নীতি গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র। এই নীতির পথ ধরেই ইসরায়েল এবং উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্প্রতি নতুন এক জোট তৈরি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাময়িকী নিউজলাইনের সম্পাদক হাসান হাসান বলেন, ‘আরব দেশগুলো মনে করতো আমেরিকার নেতৃত্ব ছাড়াই তারা এই অঞ্চলের মানচিত্র নিজেরাই নতুন করে তৈরি করে নিতে পারবে। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে সেই চেষ্টা করার পর তারা এখন বুঝতে পারছে লিবিয়া, ইরান এবং এমনকি ক্ষুদ্র একটি দেশ কাতারের ব্যাপারেও তাদের ক্ষমতা সীমিত।’
‘ওবামা প্রশাসনে যে মানুষগুলো ছিলেন তাদের ক'জনকে এখন খুবই উদ্যমী ভূমিকা রাখতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এখন এটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয়।’
পুরোনো মিত্রদের সাথে নতুন সম্পর্কের সূচনা আমেরিকার নতুন প্রশাসনের অগ্রাধিকারের শুরুর দিকে রয়েছে। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন এ বিষয়ে সিনেট শুনানিতে বলেছেন, ‘শুরুতেই এই অঞ্চলে আমাদের মিত্রদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা খুবই প্রয়োজন। এই মিত্রদের মধ্যে যেমন ইসরায়েল রয়েছে তেমনি উপসাগরীয় দেশগুলোও রয়েছে।’
বহুদিন ধরে বারাক ওবামা এবং জো বাইডেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করা ব্লিনকেন সিনেটে চার ঘণ্টা ধরে চলা শুনানিতে বারবার গুরুত্ব দিয়ে দিয়ে ইরানের প্রসঙ্গ টেনেছেন।
তিনি বলেন, ‘পরমাণু কর্মসূচি ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অস্থিরতা তৈরির তৎপরতা এবং তাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে নতুন মীমাংসা প্রয়োজন। পশ্চিমা অন্যান্য দেশগুলোরও মতামতও একই।’
তবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ২০১৫ সালে করা চুক্তি - যেটিকে বহুপাক্ষিক কূটনীতির বিরল একটি সাফল্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়, সাম্প্রতিক সংকট মোকাবেলায় বাইডেন প্রশাসন গুরুত্ব দেবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ইউরোপীয় কাউন্সিলের বৈদেশিক সম্পর্ক শাখার মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিভাগের উপপরিচালক এলি জেরানমায়ে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আপনি যদি বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতি, পারমানবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া লোকগুলোর দিকে তাকান, দেখবেন তাদের অনেকেই ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।’
‘বাইডেন প্রশাসন এবং ইরানের নেতৃত্ব উভয়েই একমত যে এই চুক্তির সব পক্ষকে একত্রিত করে চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত এবং এ কাজটি তাদের দ্রুত করতে হবে।’
চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেরিয়ে যাওয়া এবং ইরানের ওপর সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে তেহরান পারমাণবিক চুক্তিতে করা প্রতিশ্রুতি থেকে ধীরে ধীর দূরে সরে যাচ্ছে।
সম্প্রতি তেহরান ইউরেনিয়াম শোধনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ার কথা জানিয়েছে, যা উদ্বেগ তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে। অন্যদিকে গত চার বছরে ইরানের অভ্যন্তরে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে ভরসার অভাব দেখা যাচ্ছে ইরান সরকারের মধ্যে।
ইরান চায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপানো সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। ইরান সরকারের নেতারা ক্রমাগত বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে তারাও চুক্তি অনুসরণ করবে।
তবে এ ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনকে দেশের ভেতরও আপত্তির মুখে পড়তে হতে পারে; কারণ নতুন নির্বাচিত কংগ্রেস, যাদের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতির অনেক অভিজ্ঞ লোকজন এখন রয়েছেন, তারা বিদেশনীতিতে অধিকতর মতামতের অধিকার চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কংগ্রেস ইরানবিরোধী লোকজনে পরিপূর্ণ।
খাসোগি ও সৌদি আরব
ইরান ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে আরো যেসব বিষয়ের দিকে বাইডেন প্রশাসন মনযোগ দেবে সেগুলো হলো : ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধ, ইসরায়েল-আরব শান্তি চুক্তি, সৌদি আরবে মানবাধিকার, বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ এবং সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে চুক্তি হবে, তার প্রভাব এসব বিষয়ের উপরও পড়বে।
বাইডেন যাকে তার জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন, সেই আভরিল হেইনসকে কংগ্রেসে নিয়োগের শুনানির সময় প্রশ্ন করা হয়, ট্রাম্প সরকারের ‘বেআইনি তৎপরতা’ বন্ধে তিনি পদক্ষেপ নেবেন কি না এবং সাংবাদিক খাসোগি হত্যার একটি পূর্ণাঙ্গ একটি রিপোর্ট তিনি কংগ্রেসকে দেবেন কিনা।
উত্তরে আভরিল হেইনস বলেন, ‘হ্যাঁ সিনেটর, অবশ্যই। আমরা আইন অনুসরণ করব।’
গোয়েন্দা সূত্রের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক নির্ভরযোগ্য মিডিয়া বলে আসছে, সিআইএর কাছে বেশ জোরালো প্রমাণ রয়েছে যে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানই জামাল খাসোগির হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সৌদি যুবরাজ অবশ্য সবসময় এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কিন্তু এ বিষয়ে সৌদি যুবরাজকে ‘লাইনে’ আনতে বাইডেনকে বেগ পেতে হবে ইঙ্গিত করে সৌদি লেখক ও বিশ্লেষক আলী শিহাবি বিবিসিকে বলেন, ‘আমেরিকানদের উচিৎ যুবরাজকে তাদের সন্দেহের দৃষ্টি থেকে সরানো, কারণ সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ এ ব্যাপারে নেই।’
‘সিআইএ হোক আর পেন্টাগন হোক বা পররাষ্ট্র দপ্তর হোক, সৌদি আরব যে আমেরিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বাস্তবতা তাদের বুঝতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যে কোনো কিছু করার জন্য সৌদি আরবকে তাদের দরকার।’
তবে অনেক বিষয়ে সৌদি এবং আমেরিকার নীতির মধ্যে ঐক্যমত্য হওয়া সম্ভব। যেমন, ইয়েমেনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক বিষয়ের মতো এই সমস্যারও সহজ কোনো সমাধান নেই।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইয়েমেন বিশেষজ্ঞ পিটার স্যালসবেরি বলেন, ‘সৌদি আরবের জন্য সামরিক সহযোগিতা বন্ধ অতটা সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি সেখানে শান্তি চায় তাহলে কূটনৈতিকভাবে তাদের আরো তৎপর হতে হবে।’
কূটনৈতিক সেই তৎপরতায় অপ্রীতিকর বহু বিষয় উঠে আসবেই, বিশেষ করে মানবাধিকারকে যখন বাইডেন প্রশাসন তাদের এজেন্ডায় জায়গা দিয়েছে। তার অর্থ, রিয়াদ থেকে শুরু করে তেহরান, কায়রো বা অন্যত্র কথাবার্তা বলার সময় জটিল এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামলাতে হবে বাইডেন প্রশাসনকে।
এসএমডব্লিউ