টিকা নেওয়ার কত দিন পর সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা?
কোভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ইসরায়েল। তাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশকেই ইতোমধ্যে অন্তত এক ডোজ টিকা দেওয়া হয়ে গেছে।
এই দেশটি থেকে কী তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় তা জানতে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এখন অপেক্ষা করছেন। কারণ ইরায়েলের তথ্য পেলেই বোঝা যাবে যে, একটা দেশের পুরো জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার পর তা করোনাভাইরাস দমনে কতটা কার্যকর হলো।
বিজ্ঞাপন
বাস্তবতা হলো, টিকা দেওয়ার পরও হাজার হাজার লোক করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়েছেন বলে টেস্টে দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
ইসরায়েলের কোভিড মোকাবিলা কর্মসূচির সমন্বয়কারী অধ্যাপক ন্যাশম্যান এ্যাশ বলেছেন, ফাইজারের টিকার একটি মাত্র ডোজ হয়তো ততটা কার্যকর নয়, যতটা আগে ভাবা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হওয়া লোকের সংখ্যা আমরা এখনও কমে আসতে দেখছি না।’
তার এ কথার পর সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগ। কিন্তু এ উদ্বেগ কী একটু বেশি আগেভাগে প্রকাশ করা হয়েছে?
অধ্যাপক এ্যাশের এই বক্তব্যকে ‘নির্ভুল নয়’ আখ্যায়িত করে ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, টিকার কি প্রভাব পড়লো তার পূর্ণরূপ শিগগিরই দেখা যাবে।
ইমিউনিটি তৈরি হতে দুই-তিন সপ্তাহ লাগে
টিকা দেওয়ার পর মানবদেহ করোনাভাইরাসের জেনেটিক উপাদানগুলো চিনে নিতে এবং অ্যান্টিবডি ও টি-সেল তৈরি করতে বেশ খানিকটা সময় নেয়। তারপরই এগুলো ভাইরাসের দেহকোষে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বা আক্রান্ত কোষগুলোকে মেরে ফেলতে শুরু করে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ইমিউনোলজিস্ট অধ্যাপক ড্যানি অল্টম্যান ভরছেন, ‘মানবদেহে টিকার পুরো কার্যকারিতা তৈরি হতে কমপক্ষে দু-সপ্তাহ বা সম্ভবত আরও বেশি সময় লাগে।’
ইসরায়েলে কী ঘটেছে?
ইসরায়েলে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যাদের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে - তারা হয়তো টিকার প্রথম ডোজটি নিয়েছেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, টিকা কার্যকরী হয়নি।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা দাতা প্রতিষ্ঠান ক্ল্যালিট এ প্রশ্নের জবাব পেতে চার লাখ মানুষের মেডিকেল রেকর্ড পরীক্ষা করেছে। এই চার লাখ মানুষের সবাই ৬০ বছরের অধিক বয়সী। এদের মধ্যে দুই লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন এবং আর বাকি দুই লাখ ষাটোর্ধ মানুষ টিকা নেননি।
প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার দু’সপ্তাহ পর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, দুই গ্রুপেই করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়া লোকের অনুপাত মোটামুটি সমান। কিন্তু তারপর থেকে টিকা নিয়েছেন এমন লোকদের মধ্যে নতুন করে ভাইরাস সংক্রমণের পরিমাণ ৩৩ শতাংশ কমে যেতে দেখা যায়।
ক্ল্যালিটের কর্মকর্তা র্যান বালিশার বলছেন, এটা হচ্ছে প্রথম পর্যায়ের সুরক্ষা এবং এখনই সংক্রমণ ৩৩% কমতে দেখা যাচ্ছে। এরপরে সংক্রমণ আরো কমে যেতে দেখা যায়। কিন্তু অধ্যাপক বালিশার বলছেন, শতকরা হার হিসেব করার জন্য এ সংখ্যা এখনও কম।
তিনি আরও বলেন, টিকার ফলে করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সংখ্যা কমে আসছে কিনা - তা এ সপ্তাহ শেষের দিকে বোঝা যাবে।
ফাইজারের জরিপেও একই প্রবণতা
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন এ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক স্টিফেন এভান্স বলছেন, এ ধরণের পর্যবেক্ষণভিত্তিক জরিপের ফরাফল তুলনা করা ঠিক নয়। তবে হাজার হাজার মানুষের ওপর ফাইজারের টিকার যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছিল তাতেও একই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল।
সেই জরিপেও দেখা গিয়েছিল- টিকা নেওয়া এবং না-নেওয়া মানুষের মধ্যে সংক্রমণের হারে ব্যবধান সৃষ্টি হতে ২ সপ্তাহ সময় লেগেছিল। প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার পর ১০০ দিন পর্যন্ত সেই ব্যবধান বাড়ছিল।
টিকা তাহলে কতটা কার্যকর হচ্ছে?
ফাইজার আশা করছে, তাদের টিকাটি দুই ডোজ দেওয়া হলে তা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা দেবে। কিন্তু এর চেয়ে অনেক কম কার্যকর একটি টিকাও কিন্তু একটি রোগের প্রাণঘাতী হয়ে ওঠা ঠেকিয়ে দিতে পারে। যেমন শীতকালীন ফ্লু প্রতিরোধী যে টিকা ব্রিটেনে প্রতিবছর দেয়া হয় তা ৪০শতাংশ-৬০শতাংশ কার্যকর। কিন্তু তা প্রতিবছর লাখ লাখ মানষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করছে।
অধ্যাপক এভান্সও তাই মনে করেন। তিনি বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়া বা মৃত্যু থেকে সুরক্ষা পাওয়াটা হয়তো কোভিড সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকারিতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
টিকা নেওয়া মানুষেরা কি ভাইরাস ছড়াতে পারে?
বিবিসির বিজ্ঞানবিষয়ক সংবাদদাতা ডেভিড শুকম্যান বলছেন, এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নন। এর কারণ হলো, টিকার ট্রায়ালগুলোতে দু'টি জিনিস দেখা হয়েছে। একটি হলো - টিকাটি নিরাপদ কিনা এবং অপরটি হলো - তা করোনাভাইরাস আক্রান্তদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া ঠেকাতে কতটা কার্যকর। দুটি ক্ষেত্রেই ভালো ফল পাওয়া গেছে।
কিন্তু টিকা নিলেও একজন থেকে আরেকজনে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে কিনা - তার অনুসন্ধান করা হয়নি। ফলে যারা টিকা নিয়েছেন তারা অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারেন কিনা - এটা অজানা।
টিকা ও রোগ ছড়ানোর সম্পর্ক এখনও অজানা
টিকা নেওয়া একজন ব্যক্তির দেহে যদি ভাইরাস ঢোকে - তাহলে তিনি হয়তো টের পাবেন না, কারণ তার কোনো উপসর্গ থাকবে না। ঠিক এ কারণেই স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন। এমন হতেই পারে যে- টিকার ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলা করতে পারে - কিন্তু তার শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশ থেকে ভাইরাসটিকে তাড়িয়ে দিতে পারে না।
ব্রিটেনের ডেপুটি প্রধান মেডিকেল অফিসার অধ্যাপক জোনাথন ভ্যান ট্যাম জোর দিয়ে বলেছেন, করোনাভাইরাস ছড়ানোর ওপর টিকা কোনো প্রভাব ফেলে কিনা তা এখনও অজানা। তিনি বলছেন, টিকা দেওয়ার পরও মানবদেহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ক্ষমতা পুরোপুরি তৈরি হতে অন্তত তিন সপ্তাহ সময় দেওয়া উচিত।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম