এক দশকে এত বড় বিক্ষোভ দেখেনি মিয়ানমার
ইয়াঙ্গুনে স্বৈরশাসনবিরোধী বিক্ষোভে লাখো মানুষের ঢল/ ছবি: এএফপি
সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় লাখ লাখ মানুষের যে বিক্ষোভ রোববার মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে জোরাল হচ্ছে; তা নিয়ে গভীর আশঙ্কার কথাও বলছেন দেশটির বিশেষজ্ঞরা। অতীতের স্মৃতি স্মরণ করে তারা বলছেন, অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ ১৯৮৮ এবং ২০০৭ সালেও শুরু হয়েছিল; সেই সময় জান্তা সরকারের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী প্রাণঘাতী উপায়ে বিক্ষোভ দমনের পথ বেছে নিয়েছিল।
গত এক দশকের বেশি সময়ের ইতিহাসে গণতন্ত্রকামীদের এত বড় বিক্ষোভ দেশটিতে কখনও দেখা যায়নি। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির মুক্তি এবং বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তুলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করার ডাক দিয়েছেন তারা।
বিজ্ঞাপন
আমরা সামরিক একনায়কতন্ত্র চাই না। আমরা গণতন্ত্র চাই।
ইয়াঙ্গুনের প্রাণকেন্দ্রে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক তরুণ
ইয়াঙ্গুন ছাড়াও দেশটির এক ডজনের বেশি শহরে রোববার স্বৈরশাসনবিরোধী বিক্ষোভে লাখ লাখ মানুষ অংশ নেন। একদিনের বিচ্ছিন্নতার পর রোববার দেশজুড়ে পুনরায় ইন্টারনেট সচল করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
গত সোমবারের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলেও মিয়ানমারের প্রবল প্রতাপশালী সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করেনি। গত নভেম্বরে দেশটিতে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; তাতে জালিয়াতির অভিযোগ তুললেও কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি। আর এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের ব্যর্থতা সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা নিতে বাধ্য করেছে বলে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং মন্তব্য করেছেন।
বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশজুড়ে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করেছে সেনাবাহিনী। বেসামরিক সরকারের প্রধান ও রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেত্রী অং সান সু চি এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে আটকের পর নেইপিদোতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে।
সামরিক জান্তা সরকারের পাঁচ দশকের বেশি সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন শাসনের অতীত ফিরে আসার তাড়না থেকে দেশজুড়ে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে লাখ লাখ মানুষ অংশ নিচ্ছেন। স্বৈরশাসনের ধ্বংসাত্মক বিচ্ছিন্নতা আবার ফিরছে আশঙ্কায় অনেকে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নেমে আসার কথা বলছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্রপীড়িত এবং সর্বাধিক নিয়ন্ত্রিত এই রাষ্ট্রে বৃহত্তর স্বাধীনতা এবং সমৃদ্ধির কোনও কিছুই পাননি ২১ বছর বয়সী থ্য জিন। তিনি বলেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অথবা নিজেদের জন্য একনায়কতন্ত্র চাই না। স্বৈরশাসনবিরোধী লাখো মানুষের বিক্ষোভে জনসমুদ্রে পরিণত বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের সুলে প্যাগোডার সামনে ব্যানার হাতে দেখা যায় এই তরুণকে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেকের হাতে ‘আপনি ভুল প্রজন্মের সঙ্গে খেলছেন’ লেখা ব্যানারও দেখা যায়।
আবেগজড়িত কণ্ঠে থ্য জিন বলেন, ‘এবার যদি আমরা আমাদের দেশের জন্য, জনগণের জন্য না দাঁড়াই তাহলে কেউই থাকবে না। শয়তান আমাদের ওপর ভর করবে। তারা আমাদের জন্য যে ঝামেলা বয়ে এনেছে, সেজন্য তাদের কখনই ক্ষমা করবো না।’
১৯৬২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একের পর এক স্বৈরশাসক চেপে বসেছিল মিয়ানমারের মসনদে। প্রায় ১৫ বছরের গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মিয়ানমারে বেসামরিক সরকারের যাত্রা শুরু হয়। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের তথ্য বলছে, ২০১২ সালে মিয়ানমারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ। অল্প কিছু মানুষের ছিল টেলিফোন।
২০১৩ সালে বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর দেশটিতে সিম কার্ডের দাম রাতারাতি ২০০ ডলার থেকে এক লাফে মাত্র ২ ডলারে নেমে আসে। ২০১৬ সালে এসে দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে যায়; যেসবের বেশিরভাগই ইন্টারনেট ব্যবহার উপযোগী স্মার্টফোন। সেনাশাসনের জাঁতাকল থেকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের যাত্রায় দেশটিতে সেন্সরশিপ আইনের বিলুপ্তির সাথে বেসরকারি গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটে। কিন্তু দেশটিতে নতুন করে স্বৈরশাসন শুরু হওয়ার পর গণমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে জান্তা সরকার।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন গণতন্ত্রকামী হাজার হাজার মানুষ। তাদের এই আহ্বান দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে; যা আগে কখনও কল্পনা করা যেত না।
শনিবার দেশটিতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পর মানুষের মাঝে ক্ষোভ বাড়তে থাকে– যা তাদের পুরনো স্বৈরশাসনের স্মৃতি উসকে দেয়। এর ফলে দেশটির তরুণ থেকে বৃদ্ধ– যারা স্বৈরশাসনের যুগের বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন; তারাও অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে শুরু হওয়া বিক্ষোভে যোগ দেন।
২২ বছর বয়সী এক তরুণ বলেন, ‘আমাদের তরুণদের বেশিরভাগই আইটি কোম্পানিতে চাকরি করে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পর আমাদের পুরো সার্ভার অচল হয়ে যায়। আমরা কিছুই করতে পারছি না। এটি আমাদের কাজের পাশাপাশি সম্ভাবনার ওপরও আঘাত করছে।’
আমরা স্বৈরশাসন ঘৃণা করি
সুলে প্যাগোডার সামনে সামরিক শাসনবিরোধী লাখো মানুষের যে বিক্ষোভ রোববার দেখা গেছে; সেখানে এসেছেন ৪০ বছর বয়সী ম্য ম্য অং। বলেন, ‘আমরা সবাই জানি এই স্বৈরশাসন কতটা ভয়াবহ ছিল। আমরা সেনাবাহিনীর বুটের নিচে বাঁচতে পারি না। আমরা স্বৈরশাসন ঘৃণা করি। আসলেই আমরা এটি ঘৃণা করি।’
২০০৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার যে সূচক প্রকাশ করেছিল; তাতে মিয়ানমারের অবস্থান ছিল একেবারে শেষের দিকে। সামরিক জান্তা সরকারের আমলের ভঙ্গুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা স্মরণ করে ম্য ম্য অং বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকদিন ভয়ের মধ্যে বসবাস করি। আমরা সবকিছুতে প্রতিবেশিদের চেয়ে পিছিয়ে আছি।’
অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভের দাবানল যখন বাড়ছে তখন আমরা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করছি যে, প্রতিক্রিয়াও আসছে। কিন্তু মিয়ানমারের সমাজ ১৯৮৮ এবং ২০০৭ সালের চেয়ে বর্তমানে পুরোপুরি ভিন্ন। আজকের তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমরার অগাধ আস্থা আছে। যেকোনও কিছু সম্ভব।
মিয়ানমারের লেখক এবং ইতিহাসবিদ থ্যান্ট মিন্ট-ইউ
শনিবার যখন দেশটির নতুন জান্তা সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, তখন পুরনো দিনের স্মৃতি অনেকের সামনে ভেসে উঠে। এর পরপরই রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকার কর্মীরা আত্মগোপনে যান। দ্রুত গুজব ছড়াতে থাকে যে, এনএলডির নেত্রীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে; বেশ কয়েকজন এনএলডি নেতা মারা গেছেন এবং সেনাপ্রধান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।
রোববার সন্ধ্যার দিকে কোনও ধরনের ব্যাখ্যা ছাড়াই মিয়ানমারে ইন্টারনেট সংযোগ ফিরিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। কিন্তু তাতেও অভ্যুত্থানবিরোধীদের বিক্ষোভ কমে যাওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। আরও কী ঘটতে যাচ্ছে সেটি নিয়ে অনেকেই আতঙ্কিত। কারণ ১৯৮৮ এবং ২০০৭ সালে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ রক্তাক্ত হাতে দমন করেছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সেই ভয়ও তাড়া করছে দেশটির সাধারণ জনগণকে।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি।
এসএস