আনুশকা হত্যা : চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেতে আরও অপেক্ষা
আনুশকা হত্যা মামলার আসামি দিহান
রাজধানীর কলাবাগানে আলোচিত মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার পুলিশি তদন্ত শেষ। তবে প্রতিবেদন পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। এমনটি জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
আনুশকার ভিসেরা ও ডিএনএ রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া যাবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে দুই মাসের মতো সময় লাগতে পারে।
বিজ্ঞাপন
কলাবাগান থানা পুলিশ জানায়, আনুশকার মৃত্যুতে হত্যা মামলা হওয়ার পরই তদন্তে নামে পুলিশ। ঘটনার প্রায় দেড় মাসের মধ্যে পুলিশ তার তদন্ত কাজ শেষ করেছে। পুলিশের তদন্তে আনুশকার বন্ধু ফারদিন ইফতেফার দিহানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এছাড়া আর কারও সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কলাবাগান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আ ফ ম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘তদন্ত প্রায় শেষ। এখন সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষা ও ভিসেরা প্রতিবেদনের অপেক্ষা করছি। এ দুটি তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেই মামলার সব রহস্যের উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু এই দুই প্রতিবেদন পেতে আরও দুই মাস সময় লাগতে পারে। এসব প্রতিবেদনেই পরিষ্কার হবে দিহান ছাড়া আর কেউ এ ঘটনায় জড়িত আছে কি না।
বিজ্ঞাপন
যা নিয়ে তদন্ত করল পুলিশ
তদন্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, দিহান ও আনুশকার ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথন, দিহান ও তার তিন বন্ধুর মোবাইল ফোনের ফরেনসিক টেস্ট, বাসা ও আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, দিহানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং দারোয়ান দুলাল মিয়ার সাক্ষীর বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে।
ধর্ষণ বা হত্যায় দিহানের তিন বন্ধুর সংশ্লিষ্টতা মেলেনি
পুলিশ বলছে, পুলিশের কাছে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ ও আলামতে দিহান ছাড়া অন্য কারোর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে পরিষ্কার হবে দিহান ছাড়া এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত ছিল কিনা। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের তদন্তে এখন পর্যন্ত দিহান ছাড়া এ ঘটনায় কারোর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।’
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে আরও সময় লাগবে
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন আসতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে। ময়নাতদন্তে প্রাথমিক কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও আমরা ভিসেরা পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষা করছি। এই ফলাফল আসতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। আর এরপরেই আমরা পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।
ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে সিআইডির সিনিয়র এএসপি (মিডিয়া) জিসানুল হক জিসান বলেন, আনুশকার ডিএনএ পরীক্ষা চলছে। প্রতিবেদনে পেতে আরও কিছু দিন সময় লাগতে পারে।
তদন্তে সঠিক তথ্য উঠে আসবে: আনুশকার বাবা
মেয়ের হত্যাকাণ্ড ও তদন্তের বিষয়ে আনুশকার বাবা আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পুলিশের ওপর আস্থা রয়েছে। তদন্তে সঠিক তথ্যগুলো উঠে আসবে বলে আমরা আশাবাদী। ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার মেয়েকে শুধু দিহান নয় তার তিন বন্ধু মিলে পাশবিক নির্যাতন করে যে হত্যা করেছে সে বিষয়টি এই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসবে বলে আশাবাদী। আর যদি তা কোনো কারণে না হয়, তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।
দিহানের মায়ের খোলা চিঠি
অন্যদিকে শুরু থেকে দিহানের পরিবার দাবি করে আসছে যে দিহান ইচ্ছা করে আনুশকাকে হত্যা করেনি। তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক পরস্পরের সম্মতিতে হয়েছে। কিন্তু শারীরিক সম্পর্কের পর দুর্ঘটনাবশত আনুশকার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে।
গণমাধ্যমকে পাঠানো খোলা চিঠিতে দিহানের মা বলেছেন, ধর্ষণের উদ্দেশ্যে নয়, একান্তে সময় কাটাতে বাসায় আনুশকাকে ডেকেছিল দিহান। উভয়ের বয়স কম। একজন নাবালিকা ও আমার ছেলেরও বয়স ১৮ বছর ৭ মাস অর্থাৎ কিশোর। আবেগের বশে উভয়েই শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল। পরবর্তীতে যা হয়েছে তা নিতান্তই দুর্ঘটনা মনে হচ্ছে। আমার ছেলে ধর্ষক বা হত্যাকারী হলে সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করত। কিন্তু সে তা করেনি। সে নিজে গাড়িতে করে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। মেয়ের মাকে ফোন করেছে। পুলিশের কাছে ঘটনা স্বীকার করেছে। আমার ছেলে যদি মেয়েটির সঙ্গে অন্যায় করে তাহলে একজন নারী হিসেবে আমিও আমার ছেলের যথাযথ বিচার চাই।
কিন্তু মেয়ের ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল কিনা ও একমাত্র শারীরিক সম্পর্কের কারণেই রক্তক্ষরণ এবং মৃত্যু হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে পুলিশ প্রশাসনের ওপর আমি বিশ্বাস রাখতে চাই। বিচার বিভাগের ওপর আস্থা রাখতে চাই। বিচারের আগে আমার ছেলেকে ধর্ষক বা হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত না করার জন্য সমাজের সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
দিহান ও তার বন্ধুদের নিয়ে আনুশকার পরিবারের যত অভিযোগ
আনুশকার মৃত্যুর শুরুতে দিহানকে দায়ী করে আসছিল তার পরিবার। ঘটনার একদিন পর থেকে এর সঙ্গে দিহানের তিন বন্ধুকেও দায়ী করছে আনুশকার পরিবার। যদিও মামলার এজাহারে দিহানকেই অভিযুক্ত করেছে আনুশকার পরিবার।
এ বিষয়ে আনুশকার বাবা বলেন, এ ঘটনায় দিহান একা জড়িত নয়। তার তিন বন্ধুও জড়িত। আমার ধারণা দিহান আর তার তিন বন্ধু মিলে আনুশকাকে জোর করে বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে অমানবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলে। পরে ঘটনা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে তারা আমার মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এছাড়া আমার মেয়েকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। ঢামেক হাসপাতালের অনেক পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে, একজনে এই কাজ করে নাই। তাকে নানানভাবে পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এখন বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি দিহানের তিন বন্ধুও জড়িত আছে। তাই তাদের প্রতি আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। এছাড়া দিহানের তিন বন্ধুর মধ্যে একজনের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। সে কোথায় থেকে এসেছে এবং কেন এসেছে। কিন্তু এখন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
জীবনে বাঁচাতে বাবাকে ফোন দিয়েছিল আনুশকা?
এদিকে গত ১০ জানুয়ারি এ ঘটনায় চাঞ্চল্যকর এক তথ্য দেন আনুশকার বাবা। তিনি দাবি করে বলেন, ঘটনার দিন আনুশকা, দিহান ও তার পরিবারের নির্যাতন থেকে বাঁচতে তাকে ফোন করেছিল। কিন্তু তিনি অফিসের ব্যস্ততায় ফোন ধরতে পারেননি।
এ বিষয়ে আনুশকার বাবা ঢাকা পোস্টকে গত ১০ জানুয়ারি বলেন, ঘটনার দিন দুপুর ১২টা ১৯ মিনিটে আনুশকা আমাকে ফোন দেয় তারা মোবাইল থেকে। তখন আমি মিটিংয়ে থাকায় কল কেটে দেই। পরে নানা ব্যস্ততায় তাকে কল ব্যাক করতে পারিনি। আমার এখন মনে হচ্ছে আনুশকা যখন কোচিংয়ে যাচ্ছিল তখন হয়তো দিহান তিন বন্ধুকে নিয়ে তাকে রাস্তায় বাঁধা দিচ্ছিল। নয়তো আনুশকাকে যখন তারা নির্যাতন করছিল তখন সে আমাকে ফোন দেয়। ফোনটা না ধরা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। আমি যদি ফোনটা রিসিভ করতে পারতাম, তাহলে আমার মেয়েকে নির্যাতন বা রাস্তায় বাঁধা দেওয়ার কথা বলত। তখন আমি দ্রুত ব্যবস্থা নিলে ঘটনা এত দূর আসত না। আমি মিরপুরে ছিলাম, এমন কিছু জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে পারতাম। আমার মেয়েকে তারা প্রেসারাইজড করেছে। না হয় আমার মেয়ে ঐদিকে যাওয়া কথা না। আমি এসব কথা পুলিশকেও জানিয়েছি।
ঘটনার শুরু থেকে শেষ
গত ৭ জানুয়ারি দুপুরে মাস্টার মাইন্ড স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইফতেখার ফারদিন দিহান নামে এক যুবক তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে জানা যায়, আনুশকা দিহানের বাসাতেই ছিলেন। সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনায় দিহান ও তার তিন বন্ধুকে আটক করে পুলিশ।
ঘটনার দিন রাতে কলাবাগান থানায় দিহানকে আসামি করে মামলা করেন আনুশকার বাবা মো. আল আমিন। ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ এর ২ ধারায় মামলাটি করা হয়। পরদিন ৮ জানুয়ারি দিহানকে আদালতে তোলা হলে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
ওইদিন বিকেলে আনুশকার লাশের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেসনিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে আনুশকার মৃত্যু হয়েছে। তার যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথ দুই দিক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ময়নাতদন্তে দেহের দুই অংশেই আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে ধস্তাধস্তির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, চেতনানাশক কোনো কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কি না তা জানার জন্য নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। ঘটনাস্থলে একাধিক ব্যক্তি ছিলেন। তাদের ডিএনএ নমুনা ও ভিসেরাও সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় শুক্রবার রাতে দিহানের তিন বন্ধুকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। পরে গত ৯ জানুয়ারি আনুশকাকে কুষ্টিয়ায় তার নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়।
এমএসি/ওএফ