দীপন হত্যা: ৮ জঙ্গির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে
রায়ের দিন কারাগার থেকে আসামিদের আদালতে তোলা হয়
জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আট জঙ্গির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এসেছে।
বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, দীপন হত্যা মামলার আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও মামলার নথিপত্র ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল থেকে হাইকোর্টে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে হাইকোর্টের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এটাই ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত। ডেথ রেফারেন্সের পাশাপাশি বিচারিক আদালতের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল দায়ের করে থাকেন। এখন সরকার যদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব ডেথ রেফারেন্সের শুনানি করতে চান তাহলে রেজিস্ট্রার কার্যালয় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে থাকে।
দীপনকে কুপিয়ে হত্যার মামলায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আট জঙ্গির ফাঁসির রায় দেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। মামলায় আট আসামির সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে রায়ে। তাদের মধ্যে জিয়াসহ দুজন পলাতক।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে লেখক-প্রকাশক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের ওপর ধারাবাহিক হামলার মধ্যে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ে আক্রান্ত হন দীপন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে দীপনকে গলাকেটে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আট আসামি হলেন- বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া, আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান, আবদুর সবুর সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু, খাইরুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে জিসান, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার ও শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের। গত ১০ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) মামলার রায়ে আসামিদের সবার মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
আসামিদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক। বাকিরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তারা সবাই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য।
দীপনকে যে বছর হত্যা করা হয়েছিল, সেই ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা চলার সময় টিএসসিতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়কে। এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়সহ কয়েকজন ব্লগার-লেখককে হত্যা করা হয়।
এরপর ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে দীপনকে হত্যার দিন একই সময়ে লালমাটিয়ায় আরেক প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে একই কায়দায় কোপানো হয়েছিল। তবে টুটুলসহ তিনজন বেঁচে যান।
জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর দুই প্রকাশনা থেকেই বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়। দুটি ঘটনাতেই জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের নাম আসে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই জঙ্গি দলের সামরিক কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা জিয়ার পরিকল্পনা এবং নির্দেশেই দীপনকে হত্যা করা হয়।
ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যার পর ওই দিনই তার স্ত্রী রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। তিন বছর পর ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার ফজলুর রহমান। অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৬ জনকে সাক্ষী করা হয়।
রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংসের উদ্দেশ্য ছিল আসামিদের
রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংস করে দেওয়াই দীপন হত্যা মামলার আসামিদের উদ্দেশ্য ছিল বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন বিচারক।
পর্যবেক্ষণ বিচারক বলেছেন, ‘ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করার কারণে জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে পরিকল্পনা করে হত্যা করা হয়। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এ সদস্যদের লক্ষ্য ছিল ব্লগার, লেখক, প্রকাশকদের হত্যা করে মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া। মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা। আর এসবের উদ্দেশ্য হলো মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ করে দেওয়া’।
বিচারক আরও বলেন, ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা বাংলাদেশের জননিরাপত্তা বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে দেশের গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমূলক কার্য করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।’
এমএইচডি/জেডএস