১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিটিভির চার কর্মকর্তাকে হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছেন হাইকোর্ট। এর ফলে বিচারিক আদালতে এ মামলা চলতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

বুধবার বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম রাবেয়া (মিতু), সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল শামীম খান ও কাজী সামসুন নাহার।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বিটিভির চারজন কর্মকর্তা যখন অফিসে গেলেন, তখন সেখানে সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা ছিলেন এবং বিটিভির কিছু কর্মকর্তা এ চারজনকে একটা রুমে নিয়ে আটকে রাখেন। এভাবে যখন তাদের আটকে রাখেন, তখন তাদের পরিবারের লোকেরা গেলে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে তারা জানান। কিন্তু তারা তাদের ছাড়েননি।

পরে ওই দিনই তাদেরকে গাড়িতে করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হয়।  এরপর আর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টেলিভিশনের পাশের খালে তাদের লাশ ভেসে উঠে। পরে তাদের পরনের কাপড় চোপড় দেখে তিনজনকে শনাক্ত করা হয়। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে কিছুই পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়। ওই রিপোর্ট আদালত গ্রহণ করেন। এরপর মামলাটি বন্ধ হয়ে যায়। 

এরপর ১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তিত হলে নিখোঁজ একজনের পরিবারের সদস্য ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার সিআইডির কাছে পাঠায়। সিআইডি তখন আদালতে আবেদন করে পুনঃতদন্তের আবেদন জানায়। তখন আদালতের অনুমতি নিয়ে পুনঃতদন্ত করে চার্জশিট দেয়। চার্জশিটে চারজনকে আসামি করা হয়। সেই সময়ে কর্মরত সামরিক ও বেসামরিক যারা ছিলেন তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।

কিন্তু এর মধ্যে মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হলে আদালত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। সেই থেকে মামলাটি স্থগিত ছিল। আজ সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে জারি করা রুল খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলে এখন মামলাটি চলবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রেডিও ও টিভি স্টেশনে সেনা মোতায়েন করা হয়। ওই সময় দাবি-দাওয়া নিয়ে বিটিভির তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কল্যাণ সমিতির আন্দোলন চলছিল। রামপুরা টিভি ভবনে নিয়োজিত অনারারি লেফটেন্যান্ট (অব.) আলতাফ হোসেনের সঙ্গে কর্মচারী নেতাদের সমঝোতা হয়।

৬ নভেম্বর রাতে আলতাফসহ আসামিদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আটক করে দাবি আদায় করা হবে। পরদিন সকালে মনিরুল, আকমল ও সিদ্দিক ফটকে এলে তাদের বিটিভির ১০১ নম্বর কক্ষে আটকে রাখা হয়। পরে ক্যামেরাম্যান ফিরোজকেও আটক করে তারা। পরদিন রাতে তিনজনকে রামপুরা টিভি ভবনের পেছনে নিয়ে হত্যা করে হাতিরঝিলে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। চার কর্মকর্তার খোঁজ না পেয়ে ১৯ নভেম্বর তাদের স্ত্রীরা গুলশান থানায় চারটি অপহরণ মামলা করেন।

হাতিরঝিলের পানি শুকিয়ে গেলে ১৯৭৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনটি কংকাল পাওয়া যায়। ফরেনসিক পরীক্ষায় সেগুলো কাইয়ুম, সিদ্দিক ও আকমলের বলে চিহ্নিত হয়। কিন্তু মনিরুলের খোঁজ মেলেনি। ১৯৭৮ সালে গোয়েন্দা পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলে আটকে যায় হত্যাকাণ্ডের বিচার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আকমলের স্ত্রী মনোয়ারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন।

১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হয়। মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুল করিম খান ১৯৯৯ সালে অভিযোগপত্র দেন। অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার হয়ে পরে জামিনে মুক্ত হন।

২০০২ সালে মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসে। পরের বছর ৯ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিরা হলেন— একেএম জাকারিয়া হায়দার, আবুল কাশেম, সৈয়দ আইনুল কবীর, আয়নুজ্জামান এবং সাহজাহান মিয়াজী, আবুল কাশেম বাগোজা, লুৎফর রহমান তালুকদার, আলতাফ হোসেন ও আবদুল আউয়াল সরকার। আসামি আলতাফ ২০০৪ সালে হাইকোর্টে মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। ২০০৫ সালে মামলার কার‌্যক্রম স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে আটকে ছিল বিচার।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম বলেন, আসামিদের মধ্যে আয়নুজ্জামান ২০০৪ সালে মারা যান। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আরও তিনজন মারা গেছেন। দুই আসামি পলাতক রয়েছেন।

এমএইচডি/আরএইচ