আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত
জুডিশিয়ারির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন খায়রুল হক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল মামলার মূল রায়দানকারী হিসেবে রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক সমালোচিত সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকালে এ বি এম খায়রুল হককে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। দেরিতে হলেও তাকে গ্রেপ্তার করায় অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আইনজীবী নেতা এবং আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞাপন
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজের রায় পাল্টিয়ে খায়রুল হক বিচার বিভাগ ও সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। তার পরিণতি দেখে যেন বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিচারপতিরা সাবধান হয়ে যান। বিচার বিভাগে যেন আর কোনো খায়রুল হকের মতো বিচারপতির জন্ম না হয়।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিনিময়ে বিচারপতি খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। খায়রুল হকের এমন বিচার করতে হবে যেন তাকে দেখে অন্য বিচারপতিরা সাবধান হয়ে যান। খায়রুল হকের কারণে আয়নাঘর তৈরি হয়েছিল। গণতন্ত্র ধ্বংস করে তিনি হাজার হাজার মানুষ হত্যার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তার বিচার জনতার আদালতে হতে হবে। উন্মুক্ত আদালতে হতে হবে। খালেদা জিয়াকে শহীদ জিয়ার স্মৃতি বিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দিয়েছিলেন খায়রুল হক। বিচারিক অসাধুতার নগণ্য নজির তিনি স্থাপন করেছিলেন।
বিজ্ঞাপন
মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদকে কলংকিত করেছেন। প্রকাশ্য আদালতের রায় পাল্টিয়ে তিনি জুডিশিয়ারি ও সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
আরও পড়ুন
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, যেদিন এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হয়েছেন, সেদিন থেকে বিচার বিভাগ নষ্ট হতে শুরু হয়েছে। তিনি বিচারের নামে অবিচার করে গেছেন। নিজস্ব দলের প্রতি তার যে আনুগত্য ছিল, প্রত্যেকবার তা চরিতার্থ করেছেন। তার আচরণ, শরীরের ভাষা এবং বিচারিক সিদ্ধান্তে একটি দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন। একটি দলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য আইনের অপব্যবহার করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি।
তিনি বলেন, একটি বিশেষ দলের প্রতি তার অসাধারণ আনুগত্য ছিল। বিচারকের যে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ এবং বিচক্ষণতা, সেটা তার ছিল না। এটা অবধারিত ছিল, আজ হোক বা কাল, পৃথিবীতে তার বিচার হবে। তাকে যে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, এটা স্বাভাবিক। আমি মনে করি আইন আইনের মতোই চলবে। একজন সাধারণ নাগরিকের মতোই তার বিচার হবে। বিচারপতি মানিক যেমন জুডিশিয়ারিকে বারবার অপমানিত করেছিলেন, বিচারপতি মানিকের যে পরিণতি হয়েছে, বিচারপতি খায়রুল হকের একই পরিণতি হবে, এটা অবধারিত।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বিচারপতি খায়রুল হক ছিলেন একজন জ্ঞানপাপী। গণতন্ত্র হত্যা এবং শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট বানানোর প্রধান আর্কিটেক্ট হলেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। তার এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত যাতে ভবিষ্যতে নতুন কোনো খায়রুল হক বিচারাঙ্গনে জন্ম না নেয়।
ফৌজদারি আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘বাংলাদেশের বিচারপতিরা যে শপথ নেন, সেখানে বলা আছে কোনো রকম রাগ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কিন্তু এই বিচারপতি খায়রুল হক অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে। এটা আসলে কী? অভিযোগটা কী? অভিযোগটা হলো—একটি আদেশ যা উন্মুক্ত আদালতে ঘোষণা করা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়ার সময় এই আদেশটিকে পরিবর্তন করে ফেলেছেন। এই যে পরিবর্তন করে ফেলা, এই পরিবর্তন করে ফেলার মাধ্যমে যে বিচারিক প্রতারণা করা হয়েছে, এই প্রতারণা আমরা আর কোনোভাবেই বিচার বিভাগ থেকে দেখতে চাই না। যেই করুক না কেন, যত বড় বিচারকই করুক না কেন, এটি একটি অপরাধ।
তিনি বলেন, বিচারিক আদালতের ঘোষিত রায় পরবর্তী সময়ে আরেকটি বিচার ছাড়া এইভাবে পরিবর্তন করা যায় না। আমি মনে করি, এটি মার্জনা অযোগ্য; এমনটা হতে পারে না। বাংলাদেশে সবচেয়ে বিপজ্জনক যা ঘটেছে, সেটি বলেছিলেন বিচারপতি টি এইচ খান। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলায় অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন। তিনি এসে আদালতে বলেছিলেন, “আপনারা আজকে যে আগুন নিয়ে খেলছেন, দেশ কিন্তু এই আগুনে পুড়বে,” যদি এই সিস্টেম (তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা) আপনারা বাতিল করেন। আপনারা দেখবেন, বিগত ১৫ বছরে আমাদের এই মাতৃভূমিতে আগুনই জ্বলেছে। নির্বাচন কমিশন ধ্বংস হয়ে গেছে, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে।
আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “আমি মনে করি, বিচারপতি খায়রুল হক যদি এই প্রতারণা না করতেন, তাহলে পরবর্তী সময়ে এই ধরনের পরিস্থিতি বা বাস্তবতা জাতিকে বহন করতে হতো না। এ জন্য বিচার হবে আইন অনুযায়ী। বিচার আইনের বাইরে করা যাবে না। যে আইনে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন, সেই আইন অনুযায়ীই তার বিচার করতে হবে। বিচারের ক্ষেত্রে যাতে অবিচার করা না হয়, সেটাও আমরা সতর্কতার সঙ্গে বলতে চাই। কোনো ব্যক্তিকেই যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা না হয়।”
গ্রেপ্তার নিয়ে এক প্রশ্নে শিশির মনির বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধিতে যে সংশোধন এসেছে, তাতে তদন্তকারী কর্মকর্তা চাইলে একজন ব্যক্তিকে প্রাথমিক প্রমাণ সংগ্রহ করার পর গ্রেপ্তার করতে পারেন। আমার ধারণা যে মামলা হয়েছে, সে অনুযায়ী প্রাথমিক তদন্ত হয়েছে। তিনি তো বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তাকে গ্রেপ্তার করার আগে অবশ্যই কার্যকর আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা প্রয়োজন। সেটাই হয়তো সরকার করেছে।
উল্লেখ্য, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আটক করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে যাত্রাবাড়ীর একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জে মোট তিনটি মামলা রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল মামলার মূল রায়দানকারী হিসেবে রাজনৈতিকভাবে সমালোচিত খায়রুল হক।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানায় খায়রুল হকের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি করে রায় দেওয়া এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা রয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী ভূঁইয়া বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ ছাড়া ঢাকাতেও মামলা রয়েছে।
দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পান খায়রুল হক। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে তার নিয়োগ কার্যকর হয়। পরের বছরের ১৭ মে তিনি অবসরে যান।
২০১৩ সালের ২৩ জুলাই খায়রুল হককে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই মেয়াদ শেষে কয়েক দফা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তাকে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়।
আপিল বিভাগে থাকাকালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল এবং ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায় দেন খায়রুল হক।
এমএইচডি/এসএম