রাজধানীর পল্লবীতে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনে গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনি হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে পর কান্নায় ভেঙে পড়েন জনির মা ও মেয়ে।

জনির মেয়ে রিতিকা আক্তার বলেন, আমরা ১২ বছর নির্ঘুম কাটিয়েছি। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যাওয়ায় অনেক হুমকি পেয়েছি। এখনো হুমকি-ধামকি পাচ্ছি। আমরা জীবনের নিরাপত্তা চাই।

জনির মা বলেন, ছেলেকে হারিয়েছি। আর তো ফিরে পাব না। এরপর জনির মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মেয়ে রিতিকাও এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।

সোমবার (১১ আগস্ট) দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে এ দৃশ্যের অবতারণা হয়।

এসময় ইশতিয়াক হোসেন জনির ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নই। হাইকোর্ট একজনকে খালাস দিয়েছেন। আবার একজনের সাজা কমিয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন-২০১৩ এ ভিকটিম পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের বিধান রাখা হয়নি। আমি এই আইন সংশোধনের দাবি জানাই।

এর আগে রাজধানীর পল্লবীতে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনে গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনি হত্যা মামলায় পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান ও এএসআই কামরুজ্জামানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন হাইকোর্ট। অপর আসামি সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল হাসানের যাবজ্জীবন দণ্ড থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। একইসঙ্গে আরেক আসামি পুলিশের সোর্স রাসেলকে ৭ বছরের সাজা থেকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।

অপর আসামি সুমন সাজাভোগ করে আগেই কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন-২০১৩ অনুযায়ী হাইকোর্টে এটিই প্রথম রায়। রায়ে যাবজ্জীবন বহাল থাকা আসামিদের দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ভিকটিম জনির পরিবারকে দিতে বলা হয়েছে। হাইকোর্টে ১০ বছর সাজাপ্রাপ্ত আসামি এএসআই রাশেদুল হাসানকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

গতকাল রোববার ও আজ সোমবার দুই দিনে এ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।

এর আগে গত ৭ আগস্ট এ মামলার দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিলের শুনানি শেষে রায়ের জন্য দিন ধার্য করা হয়।

সেদিন আদালতে আসামিপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান, সরওয়ার আহমেদ, মো. আবদুর রাজ্জাক ও নাজমুল করিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বদিউজ্জামান তপাদার। অন্যদিকে বাদীপক্ষে আইনজীবী এস এম রেজাউল করিম শুনানি করেন।

মামলার বিবরণে থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের বি ব্লকের ইরানি ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. বিল্লালের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল। সে অনুষ্ঠানে পুলিশের সোর্স সুমন নারীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। এসময় সেখানে থাকা ইশতিয়াক ও তার ভাই ইমতিয়াজকে সুমন চলে যেতে বলেন। এ নিয়ে সুমনের সঙ্গে দুই ভাইয়ের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে সুমনের ফোনে পুলিশ এসে ইশতিয়াক ও ইমতিয়াজকে ধরে নিয়ে যায় এবং থানায় নিয়ে দুই ভাইকে নির্যাতন করে। এতে ইশতিয়াকের অবস্থা খারাপ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় ইশতিয়াকের ভাই ইমতিয়াজ হোসেন একই বছরের ৭ আগস্ট মামলা করেন। সে মামলায় তৎকালীন পল্লবী থানার এসআই জাহিদুর রহমানসহ আটজনকে আসামি করা হয়। মামলাটি ২০১৩ সালে হওয়া নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে প্রথম মামলা।

একপর্যায়ে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। সে তদন্ত প্রতিবেদনে পাঁচজনকে অভিযুক্ত এবং পাঁচজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। তদন্তকালে এএসআই রাশেদুল ও কামরুজ্জামানকে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত এ মামলায় পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর বিচার শেষে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রায় দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ। সে রায়ে পল্লবী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল হাসান ও এএসআই কামরুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। তাদের প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। অপর দুই আসামি পুলিশের সোর্স (তথ্যদাতা) সুমন ও রাসেলের সাত বছর কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন বিচারিক আদালত। দণ্ডিত পাঁচ আসামির মধ্যে কামারুজ্জামান (তৎকালীন এএসআই) শুরু থেকে পলাতক। অপর আসামি সুমন সাজাভোগ করে বেরিয়ে গেছেন।

এদিকে, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জাহিদুর, রাশেদুল ও রাসেল ২০২০ সালে হাইকোর্টে পৃথক আপিল করেন। ২০২১ সালে হাইকোর্ট সেসব আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। গত ৯ জুলাই এসব আপিলের শুনানি হাইকোর্টে একসঙ্গে শুরু হয়। শুনানি শেষে গত ৭ আগস্ট হাইকোর্ট রায়ের জন্য ১০ আগস্ট দিন ধার্য করেন।

এমএইচডি/এসএসএইচ