‘গোপালগঞ্জ বলয়’ দ্বন্দ্ব ঢাকতে আইজিপি মামুনের মেয়াদ বাড়ানো হয়
ফাইল ছবি
একতরফা-ডামি আর নিশিরাতের ভোট। আওয়ামী শাসনামলে হওয়া জাতীয় তিন নির্বাচনেই খেতাব পায় এই তিন নাম। এসব নির্বাচনের প্রভাবে পুলিশ বাহিনীতেও গড়ে ওঠে রাজনৈতিক মেরুকরণ। তৈরি হয় গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক বলয়। এমনকি পুলিশের প্রধান হওয়ার দৌড়ে গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এমন দ্বন্দ্ব আড়ালে রাখতে আইজিপি পদে একে একে দুবার মেয়াদ বাড়ানো হয় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হিসেবে নিজের জবানবন্দিতে বিস্ফোরক এসব তথ্য সামনে আনেন সাবেক এই আইজিপি। জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গতকাল মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি। মামুনের জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেল।
বিজ্ঞাপন
এদিন বেলা পৌনে ১২টায় আসামির কাঠগড়া থেকে সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন চৌধুরী মামুন। শুরুতেই দেন নিজের পরিচয়। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে পুলিশে কর্মরত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
জবানবন্দিতে মামুন বলেন, আমি ১৯৮৬ ব্যাচে পুলিশ ক্যাডার হিসেবে ১৯৮৯ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেই। কর্মজীবনে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, সিআইডি প্রধান, র্যাব মহাপরিচালকসহ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি আমার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার সততা ও দক্ষতা বিবেচনায় দুবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রথমে দেড় বছর ও পরের ধাপে এক বছর আইজিপি হিসেবে সময় বাড়িয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তবে অন্যতম কারণ ছিল পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তাদের গ্রুপিং যেন প্রকাশিত না হয়।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, আইজিপি পদে পদোন্নতি পেতে পুলিশে কর্মরত উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের গ্রুপিং ছিল। এ গ্রুপিং যেন প্রকাশিত না হয় এবং পুলিশের সুনাম রক্ষার্থে আমাকে আইজিপি হিসেবে রাখা হয়। তবে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপকহারে রাজনৈতিক মেরুকরণ বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক বলয় তৈরি হয়। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা তৎকালীন সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে পড়েন। এসব কারণে বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে।
২০১৮ সালে তথা একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন চৌধুরী মামুন। ওই সময় আইজিপি ছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। তিনিই শেখ হাসিনাকে রাতের ভোটের বুদ্ধি দেন বলে জানান এই রাজসাক্ষী।
চৌধুরী মামুন বলেন, একাদশ নির্বাচনের আগের রাতেই ৫০ শতাংশ ব্যালট বাক্সে ভরে রাখতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। তার পরামর্শ অনুযায়ী বাক্সে ব্যালট ভরে রাখতে ডিসি-এসপি, ইউএনও-এসিল্যান্ড, ওসিসহ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। পরে মাঠপর্যায়ে এটি বাস্তবায়ন করেন তারা। এমনকি নির্বাচনের পর নির্দেশ পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের ডেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পিপিএম-বিপিএম পদক দিয়ে পুরস্কৃত করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। আর ওই নির্বাচনের পরই পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব আরও বেড়ে যায়। রাজনৈতিক পরিচয়ে কিছু কিছু কর্মকর্তা আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও সাবেক এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম। আর এ দুজনই পুলিশের দুটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দুই গ্রুপের বেশিরভাগ কর্মকর্তাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় আইজিপির নির্দেশ সঠিকভাবে মানতেন না। তারা নিজেদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান মনে করতেন। তবে আইজিপি হিসেবে আমি চাইতাম পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। এছাড়া পুলিশে গোপালগঞ্জের অবস্থান বেশ শক্ত ছিল। এই জেলার লোকেরাই বিভিন্ন থানার ওসিসহ উচ্চপদে সবচেয়ে বেশি ছিলেন। তারা সাধারণত কমান্ড মানতেন না। নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতেন। তাদের দেখে রাখতেন হাবিব ও মনির। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও তাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এছাড়া ঢাকার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। মূলত তাদের দিয়েই সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হতো।
জবানবন্দিতে টানা চার মেয়াদে আওয়ামী শাসনামলের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। র্যাবে থাকাকালীন টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন বা টিএফআই সেলসহ বহু বন্দিশালার বীভৎস বর্ণনাও দেন। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন বানচালে শেখ হাসিনার সরকারের ভয়ংকর নীলনকশার কথাও ট্রাইব্যুনালের সামনে আনেন আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক এই পুলিশপ্রধান। সবশেষ শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে জুলাই-আগস্টে গণহত্যা চালানো হয়েছে জানিয়ে নিজের দায় স্বীকার করে শহীদ-আহত পরিবারসহ দেশবাসী ও ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাবেক আইজিপি মামুনের জবানবন্দি শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অকাট্য দলিল হিসেবে দেখছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তবে তিনি ক্ষমা পাবেন কিনা, সেই সিদ্ধান্ত আদালতের। এখানে প্রসিকিউশনের কোনো ভূমিকা নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সাবেক আইজিপির এ সাক্ষ্যকে বিশ্বের কোনো আদালতেই দুর্বল প্রমাণ করার সুযোগ নেই। এটি অপ্রতিরোধ্য সাক্ষ্য। শুধু জুলাই আগস্টের নয়, গত ১৫ বছরে হওয়া গুম-খুনের বিরুদ্ধে অকাট্য দলিল হিসেবেও কাজ করবে তার এই জবানবন্দি।
তিনি আরও বলেন, বিবেকের তাড়নায় অপরাধ স্বীকার করেছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। নিজেই রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেছিলেন। আদালতে মঞ্জুর হওয়ার পর তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন। ফলে আদালতই তার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলেও জানান তাজুল ইসলাম।
এমআরআর/এমজে