সেদিন ছেলের রক্তে ভিজে গিয়েছিল আনাসের মায়ের কাপড়
বুকের ঠিক বাঁ পাশে লাগে গুলি। বেরিয়ে যায় পিঠ চিরে। দশম শ্রেণির এ শিক্ষার্থীর পরিচয় তখনও অজানা। তবু তাকে হাসপাতালে নেন সহযোদ্ধারা। ততক্ষণে নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। তবে পরিচয়হীন তরুণের পকেটে মেলে সিমবিহীন বাটন বা ছোট্ট ফোন। সেভ করা হাতেগোনা কিছু নম্বরের ভিড়ে ‘মা’ নামের নম্বরে দেওয়া হয় কল। অচেনা কণ্ঠে ফোন পেয়েই হাসপাতালে ছুটে আসেন সেই গর্ভধারিনী। ছেলের নিথর দেহ দেখে মায়ের কান্না ছাপিয়ে ওঠে হাসপাতালের দেয়াল। জড়িয়ে ধরেন 'নাড়িছেঁড়া ধনের' লাশ। তার রক্তে ভিজে যায় পরনের কাপড়।
মর্মস্পর্শী এমন বর্ণনা শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের সহযোদ্ধা মো. সৌরভ আহমেদের। রাজধানীর চানখারপুলে চব্বিশের ৫ আগস্ট আনাসসহ ছয় হত্যাযজ্ঞের দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৪ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। এ মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে সপ্তম দিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য ছিল আজ (১৪ সেপ্টেম্বর)। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার সৌরভের জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেল।
বিজ্ঞাপন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৌরভ বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নেই। এটা ছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন। ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে মেস থেকে সকাল ৯টায় বের হয়ে চানখারপুল এলাকায় যাই। এরপর আমরা বহু সংখ্যক আন্দোলনকারী শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার জন্য রওনা দেই। কিন্তু বার্ন ইন্সটিটিউটের সামনে পৌঁছালে আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল-সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপসহ রাবার বুলেট ও গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। এতে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন গলিতে আশ্রয় নেই। পুলিশের তীব্র গুলির মুখে আমিসহ আরো অনেকে ১ নম্বর নবাবকাটারা রোডে ঠাঁই নেই। পুলিশের গুলিতে অনেক আন্দোলনকারী আহত হন।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, দুপুর ১২টা বা ১টার দিকে আমার পাশে একজন আন্দোলনকারীর বুকের বাম দিকে গুলি লাগে। গুলিটি তার পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরে আমি ও আরেকজন আন্দোলনকারী মিলে তাকে রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাই। পথে রিকশা থেকে নেমে যান অন্য আন্দোলনকারী। পরিচয় জানা না থাকার কারণে তাকে বেনামি টিকিট কেটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একপর্যায়ে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর আমি তার পরিচয় জানার চেষ্টা করি। ওই সময় তার পকেটে থাকা একটি সীমবিহীন বাটন ফোন পাই। সেই ফোনে কয়েকটি নামের সঙ্গে মা নামে একটি নম্বরও সেভ ছিল।
সেই নম্বরে কল দিলে একজন মহিলা রিসিভ করেন। আপনাদের কেউ আন্দোলনে গিয়েছে কি না জানতে চায়।
জবাবে তিনি বলেন- আমার ছেলে আনাস আন্দোলনে গিয়েছে। আমি তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে আসতে বলি। এরপর আনাসের মা-বাবা ও নানা হাসপাতালে আসেন। আনাসকে দেখে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। আনাসকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকেন মা। এতে তার শরীরে রক্ত লেগে যায়। পরে আনাসের মৃত্যুর সনদ ও হাসপাতালে ভর্তির টিকিট তাদের বুঝিয়ে দেই। তারা আনাসের লাশটি বাসায় নিয়ে যান।
এই সাক্ষী বলেন, পরবর্তীতে আনাসের বাবা-মাকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা বিস্তারিতভাবে জানাই। রিকশাযোগে আনাসকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় অনেকেই ভিডিও করেছিলেন। রাব্বী নামের একজনও ভিডিও করেছিলেন। রাব্বীর ওই ভিডিও সম্বলিত মোবাইলটি আমার সামনে জব্দ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ ঘটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা; যাদের আদেশে গুলি করা হয়, তাদের বিচার দাবি করছি। যারা গুলি করেছে তাদেরও বিচার চাই।
সৌরভ ছাড়াও এ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আজ সাক্ষ্য দিয়েছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য অজয় কুমার ও আবদুর রহমান। সবমিলিয়ে ১৬ জন সাক্ষী নিজেদের জবানবন্দি দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এমআরআর/এমএসএ