জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করাসহ দুজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ষষ্ঠ দিনের মতো সাক্ষ্য দিয়েছেন এক নার্সসহ পুলিশের দুই সদস্য।

মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের একক বেঞ্চে তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

এ দিন বেলা সাড়ে ১১টার পর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন এএসআই (নিরস্ত্র) মো. বায়জীদ খান। পর্যায়ক্রমে সাক্ষ্য দেন এসআই (নিরস্ত্র) মো. শাহিন মিয়া ও ফরাজি হাসপাতালের স্টাফ নার্স লিংকন মাঝি।

নিজের জবানবন্দিতে লিংকন বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই জুমার নামাজের কিছুক্ষণ পর আমাদের হাসপাতালের ভেতর থেকে বাইরে গোলাগুলির শব্দ শুনেছিলাম। ওই সময় সারাদেশে ছাত্র আন্দোলন হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর গুলিবিদ্ধরা হাসপাতালে আসতে থাকেন। তাদের সংখ্যা ৮০-১০০ জন। আমরা তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে থাকি। গুরুতরদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করি। বিকেল ৪টার দিকে হাসপাতালের ল্যান্ড লাইন ফোনে একটি কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয় হাসপাতালের পাশে রামপুর থানার সামনে নির্মাণাধীন একটি তিনতলা ভবনের ছাদে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজন পড়ে আছেন। আমাদের হাসপাতালের ডা. জিহাদ স্যার, নাইট গার্ড জাহিদ, আমি ও অন্য একজন সেখানে গিয়ে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, কিছুদিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। জানতে পারি গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির নাম আমির হোসেন। এরপর রামপুরা থানা থেকে আমাদের হাসপাতালের ডা. জিহাদ স্যার, ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন, যে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমির হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় সেই চালক সিরাজকে ডাকা হয়। তাদের কাছে জানতে পারি আমির হোসেনের ঠিকানা দেওয়ার জন্য তাদের চাপ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি আমির হোসেনকে গুলি করেছেন পুলিশ কর্মকর্তা চঞ্চল ও তারিক।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে লিংকনসহ অন্য দুজনকে জেরা করেন পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেপ্তার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান। এখন পর্যন্ত এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন ১১ জন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ।

গতকাল সোমবার এ মামলায় জব্দতালিকার সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন এএসআই কামরুল হাসান ও কনস্টেবল আবদুর রহমান। গত ৪ নভেম্বর সাক্ষ্য দেন দুজন সাক্ষী। তাদের একজন পুলিশের এসআই মো. গোলাম কিবরিয়া খান ও তদন্ত সংস্থার সহকারী লাইব্রেরিয়ান কনস্টেবল আবু বকর সিদ্দিক। ৩ নভেম্বর তৃতীয়-চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন শহীদ মো. নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা ও প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইয়াকুব। জবানবন্দিতে গত বছরের ১৯ জুলাই রামপুরার বনশ্রীতে পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চালানো নৃশংস-নির্মমতার কথা ট্রাইব্যুনালের সামনে আনেন। একইসঙ্গে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চান তারা।

গত ২৭ অক্টোবর দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন গুলিবিদ্ধ বাসিত খান মুসার বাবা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। জবানবন্দিতে ১৯ জুলাই তার পরিবারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক হৃদয়বিদারক বিবরণ তুলে ধরেন তিনি। নিজের চোখের সামনেই তার একমাত্র ছেলে মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। একই বুলেটে শহীদ হন মা মায়া ইসলাম। বাচ্চা ছেলেটি বেঁচে থাকলেও কথা বলতে পারছে না। ফলে তছনছ হয়ে যায় তাদের পরিবারের সব স্বপ্ন। ২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়া আমির হোসেন।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই দিন এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারওয়ার জাহান। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনান তিনি। এরপর নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন চঞ্চল। ১৬ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।

এ মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। হাবিবুর ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

গত ১ সেপ্টেম্বর পলাতক চার আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২৫ আগস্ট পলাতক আসামিদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ৭ আগস্ট প্রসিকিউশনের পক্ষে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফর্মাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ। গত ৩১ জুলাই চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা। 

জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে রামপুরায় হোটেলে কাজ শেষে ঢাকায় থাকা ফুফুর বাসায় ফিরছিলেন আমির হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বনশ্রী-মেরাদিয়া সড়কের দুই পাশে পুলিশ-বিজিবির গাড়ি দেখে ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাশে থাকা একটি নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ছাদে ওঠেন তিনি। 

ওই সময় পুলিশও তার পিছু পিছু যায়। একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ওই নির্মাণাধীন ভবনটির ছাদের কার্নিশের রড ধরে ঝুলে থাকেন আমির। কিন্তু তাকে দেখে ফেলে পুলিশ। পরে তার ওপর ছয়টি গুলি ছোড়েন এক পুলিশ সদস্য। এতে তিন তলায় পড়ে গেলে তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন উদ্ধার করেন। এরপর বনশ্রীর একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। ওইদিন রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরেন ভুক্তভোগী এই তরুণ।

এ ছাড়া একই দিন রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নাদিম ও মায়া ইসলাম নিহত হন। একইসঙ্গে মায়া ইসলামের ছয় বছর বয়সী নাতি বাসিত খান মুসা গুলিবিদ্ধ হয়। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিলে এখনও কথা বলতে পারছে না এই শিশু।

গত ২৬ জানুয়ারি রাতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে সাবেক এএসআই চঞ্চল সরকারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি দল। এর নেতৃত্ব দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা।

এমআরআর/বিআরইউ