এটি গুলির আঘাত নয়, চুলকানির ক্ষত— আবু সাঈদ হত্যার সাক্ষীকে আইনজীবী
১৬ জুলাই ২০২৪। সকাল গড়িয়ে দুপুর। ঠিক তখনই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শামিল হন শান-এ রওনক বসুনিয়া। কিছুক্ষণ পরই কালো টি-শার্ট পরা দুই হাত মেলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণের বুকে এসে লাগে পুলিশের গুলি। সেই যুবকের নাম আবু সাঈদ। আর তাকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক শিক্ষার্থী ২৫ বছর বয়সী রওনকও।
এভাবেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে জবানবন্দি দিলেন রওনক। এ মামলায় বেরোবির সাবেক ভিসি হাসিবুর রশীদসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল আজ। ট্রাইব্যুনাল-২ এর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যদের বিচারিক প্যানেলে ১৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। অপর সদস্য হলেন- জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
বিজ্ঞাপন
রওনক বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুর পৌনে ২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে বাড়ি থেকে বের হই আমি। মিনিট কয়েক পর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেটের সামনে পৌঁছাই। তখন অনেক শিক্ষার্থীকে দেখি।কিছু ছাত্রকে ছাত্রলীগের ছেলেরা হলে আটকে রেখেছে বলে জানতে পারি। তাদের উদ্ধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও পুলিশের কোনো ভূমিকা ছিল না। এ কারণে শিক্ষার্থীরা ছাত্রদের উদ্ধারে বন্ধ থাকা গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের বাধা দিচ্ছিল পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশের লোকজন গুলি ও লাঠিচার্জ শুরু করেন। এতে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
ভয়ে রওনকও এক নম্বর গেটের বিপরীতে কাঠের ব্রিজের দিকে চলে আসেন। তখনই কয়েকজন পুলিশকে কালো টি-শার্ট পরা এক আন্দোলনকারী ছাত্রকে মারধর করতে দেখেন তিনি। কিছুক্ষণ পর ফের গেটের দিকে যান রওনক। ছত্রভঙ্গ হওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে থাকেন। তখন এক নম্বর গেটের ভেতরে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিল পুলিশ। ওই সময় গেট ধাক্কাধাক্কি করে খুলে ফেলেন শিক্ষার্থীরা।
বিজ্ঞাপন
সাক্ষী বলেন, গেট খুলতেই পুলিশের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মশিউর রহমান, আসাদ মণ্ডল, নুরুন্নবী, নূর আলম, আমির হোসেন, মাহবুব, আপেলসহ আরও কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখি। বেরোবি ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সহসভাপতি শামীম মাহফুজ, টগর, বাবুল, গ্লোরিয়াস রাব্বী, এমরান চৌধুরী, মাসুদসহ বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও আমাদের দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখনই গুলি করতে করতে ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে গেট দিয়ে আন্দোলনকারীদের দিকে আসতে থাকে পুলিশ। ফলে আবারও আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এর মধ্যে কিছু ছাত্র-ছাত্রী কুড়িগ্রাম সড়কে, কেউ লালবাগে, কেউ সরদারপাড়ার দিকে যান।
আর বিয়াম মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রওনক। সেখান থেকেই দেখেন পুলিশের সামনে দুই হাত মেলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আন্দোলনকারী এক ছাত্র। একপর্যায়ে তাকে লক্ষ্য করে কয়েকবার গুলি চালায় পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে সড়কের বিভাজক পার হয়ে বসে পড়েন ওই শিক্ষার্থী। তখন তাকে দাঁড় করিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন এক আন্দোলনকারী। কিন্তু ছাত্রটি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
জবানবন্দিতে রওনক আরও বলেন, গুলিবিদ্ধ ওই শিক্ষার্থী মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আমিসহ আরও কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে পার্কের মোড়ের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করি। এর মধ্যে পুলিশের ছোড়া গুলি এসে আমার কোমরের বাঁ পাশে ও হাঁটুর নিচে লাগে। তখন আরও কিছু ছাত্র-ছাত্রী এগিয়ে আসেন। গুলিবিদ্ধ ছাত্রটিকে পার্কের মোড়ে নিয়ে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল সাড়ে ৩টায় জানতে পারি গুলিবিদ্ধ ছাত্রটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। তার নাম আবু সাঈদ। এ ছাড়া কোতোয়ালি জোনের এসি আরিফুজ্জামান, তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম, বেরোবি পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায়ের নির্দেশে এএসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়ের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানতে পারি।
এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. হাসিবুর রশীদসহ প্রশাসনের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা রয়েছে বলে দাবি করেন এই শিক্ষার্থী। তাই একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত সবার বিচার চেয়েছেন তিনি।
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে রওনককে জেরা করেন পলাতক ২৪ জনের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স ও গ্রেপ্তার ছয় আসামির আইনজীবীরা। জেরার সময় পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ইশরাত জাহান অমিকে নিজের কোমরে লাগা গুলির ক্ষতের চিহ্ন দেখান রওনক।
এ সময় এই আইনজীবী বলেন, এটি গুলির আঘাত নয়। কোনো চুলকানির ক্ষত হবে। তিনি আদৌ গুলিবিদ্ধ হননি। মিথ্যা বলেছেন।
একপর্যায়ে সাক্ষীর উদ্দেশ্যে ইশরাত বলেন, আপনি কি গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় পরা পোশাক তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কি জমা দিয়েছেন।
রওনক বলেন, না। জমা দেইনি।
এ সময় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা অধস্তনদের গুলি করার নির্দেশ দেননি বলে দাবি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত এই আইনজীবী। জবাবে সত্য নয় বলে জানান সাক্ষী।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, সহিদুল ইসলাম, মঈনুল করিম ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান।
আজও গ্রেপ্তার ছয় আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন— এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ। তাদের উপস্থিতিতেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন সাক্ষীরা। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৩ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এমআরআর/এনএফ