মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা
পুলিশ হত্যার এক প্রশ্ন গড়াল তর্কে, হট্টগোলে শেষ ‘ঘণ্টা’
অন্য আর-দশদিনের মতোই চলছিল বিচারকাজ। কিন্তু একটি প্রশ্ন ঘিরে আচমকাই বদলে গেল পরিবেশ। আইনি তর্ক পাল্টা তর্কে গড়াল হট্টগোলে। যুক্তিতে যেন কাউকেই থামানো যাচ্ছে না। শেষমেশ সমাধান এলো বিচারকের হস্তক্ষেপে। মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় রাজসাক্ষীর জেরায় এমন দৃশ্যেরই দেখা মেলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর এজলাস কক্ষে।
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সারাদেশে হাজারও মানুষ শহীদ হয়েছেন। অঙ্গ হারিয়েছেন আরও অনেকে। সাভারের আশুলিয়ায়ও চালানো হয়েছে হত্যাযজ্ঞ। শেখ হাসিনার পতনের দিনই এখানে জীবন দিতে হয়েছিল বেশ কয়েকজন ছাত্রজনতাকে। তরতাজা ছয় তরুণকে হত্যার পর লাশও পুড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় এমন নৃশংসতার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-২ এ এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন ঘটনার সাক্ষী তথা প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত। মিলেছে লোমহর্ষক বর্ণনাও।
বিজ্ঞাপন
এরই ধারাবাহিকতায় ১৮তম কার্যদিবসে এ মামলার আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়ে মুখ খুলেছেন আশুলিয়া থানার সাবেক এসআই শেখ আবজালুল হক। ১৯ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল-২ এর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেলে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে আংশিক জেরা করেন ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফীর আইনজীবী সৈয়দ মিজানুর রহমান। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সময় চাইলে বাকি জেরার জন্য আজকের দিন (২০ নভেম্বর) ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিন সকাল সাড়ে ১০টার পর শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ। আসামির কাঠগড়ায় আনা হয় এ মামলায় গ্রেপ্তার আট আসামিকেও। এর মধ্যেই সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন রাজসাক্ষী আবজালুল। প্রথমেই নিজের অবশিষ্ট জেরা করতে আসেন কাফীর আইনজীবী। জেরার একপর্যায়ে ঘটনার দিন বা ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানায় কতজন এসআই, এএসআই, কনস্টেবল কর্মরত ছিলেন জানতে চাওয়া হয়। একইসঙ্গে সেদিনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করেন।
বিজ্ঞাপন
জবাবে আবজালুল বলেন, ওই দিন ২০ জন এসআই, ১৫ জন এএসআই ছিলেন। এর ওপরও হতে পারে। কনস্টেবল ছিলেন শতের আশপাশে। আমি একজন এসআই (নিরস্ত্র) ছিলাম। ওই দিন দুপুর ২টার দিকে থানায় খাবার খেয়েছি আমরা। থানা ভবনটি পাঁচতলার। নিচতলা-দোতলায় থানার কার্যক্রম চলতো। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় অফিসার ও ফোর্সরা থাকতেন। অস্ত্রাগারও নিচতলায় ছিল। ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৪টায় থানা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় ফল ব্যবসায়ী কামালের বাসায় যাই। তবে থানার ওসি কিংবা পরিদর্শক; কারও কাছ থেকেই অনুমতি নেইনি। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আমার ভাড়া বাসায় ছিলাম। আমার বাসা পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় ছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট থানার কেউ মারা গেছেন কিনা; তার দিকে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন আইনজীবী মিজানুর রহমান। এ সময় রাজসাক্ষী বলেন, আমাদের থানার কেউ মারা যাননি। (তবে একজন পুলিশ মারা গেছেন। তিনি অন্য ইউনিটের। এ ঘটনার তদন্ত করার দায়িত্ব আমার ছিল। কিন্তু শেষ করতে পারিনি।)
ঠিক তখনই প্রসিকিউশনের হয়ে আপত্তি জানান প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। এখানে এমন প্রশ্ন আসবে না বলেও জানান তিনি। শুধুমাত্র জবানবন্দিতে বলা বক্তব্যের ভিত্তিতে প্রশ্ন করা যাবে।
তার এ কথার জবাব দিয়ে কাফীর আইনজীবী মিজানুর বলেন, কেন আসবে না। একজন দারোগাকে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে। এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ছিলেন তিনি (রাজসাক্ষী)। এ প্রশ্ন কেন করতে পারবো না।
প্রসিকিউটর মিজানুল বলেন, না। এ মামলার সঙ্গে এটা সম্পর্কিত নই।
প্রতুত্তরে আসামিপক্ষে বলা হয়, এটা আরেকটি তদন্ত। আপনারা যেমন তদন্ত করছেন। এছাড়া আমার মনে হয় এরকম বিচার করতে কোর্ট এখানে বসেননি। সব ধরনের বিচারই করতে এসেছেন।
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রসিকিউশন এখানে আসেননি জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে প্রসিকিউটর মিজানুল বলেন, উনি (আইনজীবী) যে ডকুমেন্টস এনেছেন। এটা দেখানোর অনুমতি আছে কিনা। সাক্ষীর তালিকা ও ডকুমেন্টস দিতে হবে তাদের। তারা দিয়েছেন?
আরকেজন সুখরঞ্জন বালি তৈরি করতে চান? প্রশ্ন ছুড়ে মিজানুর রহমান বলেন, কারণ আমি যা বলেছি কোর্টের সামনে বলেছি। কাদের মোল্লার ব্যাপারে এরকম হলো কেন। সাফাই সাক্ষীর নাম দিলে থ্রেট শুরু হয়ে যায়।
প্রসিকিউটর বলেন, তাদের কোর্টে আসাই উচিত হয়নি। তারা বলতে পারে এটা হাইড (গোপন) রাখুন, তারা বলেছেন এই ল’য়ের অধীনে বিচার হবে।
তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, দুই পক্ষেই সাক্ষী নিতে গেলে এমন হয়।
এ সময় প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়, যদি বলি আইনটা খারাপ আইন। কিন্তু এই কোর্টে দাঁড়িয়ে কেউ বলতে পারবেন না। বাইরে গিয়ে বলতে হবে।
আসামিপক্ষে বলা হয়, ডিফেন্স মেটেরিয়াল দেওয়ার জন্য সাতদিন সময় চেয়েছি। আমাদের বলা হয়েছে যে, ডিফেন্স মেটেরিয়াল দেওয়ার পর সময় পাবেন। আমার আবেদন লিপিবদ্ধ আছে। বলেছে, প্রসিকিউশন উইটনেস (সাক্ষী) শেষে দিতে পারবেন।
তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, আইনকে আইনের মতো অ্যাপ্লাই করলে কাজে আসবে।
এ সময় মিজানুর রহমান বলেন, ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার উইথিন হিজ নলেজ। এটা তার নলেজের মধ্যেই আছে।
প্রসিকিউশনের জবাব, যে মেটারে আছে এটা ওই মেটারের বিষয় নয়। এক অংশ পড়ে আরেক অংশ না পড়লে হবে না।
ট্রাইব্যুনাল: আমরা সামনে এগোই।
এ সময় আবারও একই প্রশ্ন করেন কাফীর আইনজীবী। তখন প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়, যেটা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ঘুরেফিরে একই কথা বলছেন।
ওই সময় মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় মামলা করেছেন নিহত এএসআই রাজুর স্ত্রী রেশমা। যার তদন্তে ছিলেন আবজালুল। প্রসিকিউশন সে আবার একই বিষয়ে তার ক্রেডিবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে। এটা সেই বিষয় নয়। তাহলে এটা কিসের বিষয়। আইন অনুযায়ীই অ্যাপ্লাই করেছি। কিন্তু গায়ের জোরের কাছে পারছি না।
তার এমন কথায় ‘হোয়াট ইস দিস, হোয়াট ইজ দিস’ বলে ওঠে প্রসিকিউশন টিম। এ সময় কোর্টের ডেকোরাম বজায় রাখতে বলেন ট্রাইব্যুনাল।
ঠিক তখনই স্টেট ডিফেন্স পক্ষে উঠে আসেন আইনজীবী মো. আমির হোসেন। মিজানুর রহমানকে নিভৃত করতে ট্রাইব্যুনালকে তিনি বলেন, মাই লর্ডশিপ, এটা নিয়ে আমরা আর না এগোই।
তখন প্রসিকিউশন বলেন, প্রথম দিন থেকেই জেরার সময় একই প্রশ্ন করে আসছেন তিনি। আমরা আপত্তি দিয়ে আসছি।
একপর্যায়ে মিজানুরকে পরের প্রশ্নে যেতে বলেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু কিছুই বলতে পারেন না বলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। মিনিট দুয়েক পর রাজসাক্ষী আবজালুলের উদ্দেশে তিনি বলেন, পুলিশ হত্যার কোনো মামলা তদন্ত করেছেন?
এতে ফের বিরোধিতা করেন প্রসিকিউশন। এ সময় কিছুটা উচ্চবাচ্য হয় ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, একটু আস্তে কথা বলবেন।
এ সময় মিজানুর বলেন, আমি চলতে কম পারি। কিন্তু কথা ভালো বলতে পারি। এতদিন থেকে এ বিষয়ে জেরা করছেন। তাকে ওই ডকুমেন্টসে জবাব দিতে কে বাধা দিয়েছে।
আমরা কিছুই পারবো না বলে জানান দেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। কেন পারবেন না জানতে চান ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে পরের প্রশ্নে এগিয়ে যেতে বলেন। তখন আইনজীবী আমির বলেন, মিজান স্যার। বিষয়টি সমাধান করেন। সামনের দিকে এগিয়ে যান।
একপর্যায়ে সাক্ষীর বিষয়ে এ আদালতে কী অভিযোগ জানতে চান কাফীর আইনজীবী মিজানুর রহমান। এমন প্রশ্নে পুরোটা মনে নেই বলে জানান রাজসাক্ষী আবজালুল।
এর মধ্যেই প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়, এটা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না। তাকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়েছে, কেন আপনি জানেন না? ওই সময় জানেন বলে সম্বোধন করেন আবজালুল।
তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আশুলিয়ায় ছয় লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এটা জেরায় লিপিবদ্ধ হয়। আমার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ সেটা আমি জানি। (প্রসিকিউশনের আপত্তিসহ)।
ঘটনার দিন আশুলিয়া থানায় আবজালুল সশস্ত্রে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে দাবি করেন মিজানুর রহমান। কিন্তু সত্য নয় বলে জানান তিনি।
এ সময় প্রসিকিউশন থেকে আপত্তি জানালে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একটু আসতে দিন। তখন প্রসিকিউশন বলেন, উনি বারবারই একই প্রশ্ন করছেন। আসলে উনি (আইনজীবী) চাইছেন বিচারকাজ না আগাক।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, আমার মনে হচ্ছে দুই পক্ষই একই রকম চায়। সিনেমার মতো শুরু করেছেন। দুদিন হলে এ সমস্যা হয়।
আমরা একই জেরা বারবার করবো? এমন প্রশ্ন ছোড়েন প্রসিকিউশন। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেন, আমাদের সবাই বেশি কথা বলেন। এজন্য এত সমস্যা। আমাদের এগোতে দিন। আমরা কিন্তু নেমে যাবো।
এ সময় রাজসাক্ষীর উদ্দেশ্যে মিজানুর বলেন, আপনার জবানবন্দি পড়ে যা বুঝলাম, আপনি কোনো অপরাধ করেননি। এই প্রশ্ন করা যাবে না বলে ফের আপত্তি তোলেন প্রসিকিউশন। তিনি বলেন, এমন প্রশ্ন করেছেন যা ল’ পারমিট করে না। তিনি (রাজসাক্ষী) অপরাধ স্বীকার করেছেন।
প্রসিকিউশনের এমন কথায় ট্রাইব্যুনাল বলেন, ফুল অ্যান্ড ট্রু ডিসক্লোজার অলরেডি ডান। তিনি দোষ স্বীকার করেছেন।
তখন রাজসাক্ষীকে গ্রেপ্তারের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন মিজানুর রহমান। আবজালুল বলেন, চলতি বছরের মে মাসে মোহাম্মাদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে কোথায় থেকে গ্রেপ্তার করা হলো তা নির্দিষ্ট বলতে পারবো না। এমন জবাবের পরই সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছেন কিনা জানতে চাওয়া হয়। তখন রাজসাক্ষীর পক্ষ থেকে জানা নেই উত্তর আসে। গত বছরের ১৫ আগস্ট থানায় গিয়ে ঘটনার দিনের যে বর্ণনা জেনেছেন, তা শোনা বলেও উল্লেখ করেন এই রাজসাক্ষী।
তখন কাফীর আইনজীবী বলেন, আপনার বিরুদ্ধে আদালতে অসত্য অভিযোগ আনা হয়েছে। এ সময় আবারও আপত্তি জানান প্রসিকিউশন। তখন মিজানুর রহমানের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আপনি কেন যেন আজ প্লেইন রাস্তা রেখে বাঁকা রাস্তায় হাঁটছেন।
আপনাকে প্ররোচনা দিয়ে রাজসাক্ষী বানানো হয়েছে। অর্থাৎ এ মামলায় সাক্ষ্য দিলে সব অপরাধ থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে আসামিদের জড়িত করে অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন; সাক্ষীকে এমন প্রশ্ন করলে সত্য নয় বলে জানান।
এর মধ্যে ফের পুলিশ হত্যার প্রশ্ন আনেন মিজানুর রহমান। পুলিশ মেরে ব্রিজের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয় বলেও দাবি তার। তবে পুলিশ হত্যা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না বলে জানান প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। কিন্তু নিজের জায়গায় অনড় থাকেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।
পুলিশ হত্যা হয়েছে। আপনি (রাজসাক্ষী) কি দেখেননি বা শোনেননি। তখন মিজানুর বলেন, আমি বুঝতে পারছি না। কেন এই প্রশ্ন করতে পারবো না। জবাবে প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়, ডকুমেন্টস জমা দেবেন না। আকাশে-বাতাসে চিঠি লিখবেন। প্রতুত্তরে আপনি এখানে বাধা দিতে আছেন বলে প্রসিকিউটরকে ইঙ্গিত করেন কাফীর আইনজীবী। একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আমরা একই জায়গায় আছি।
প্রসিকিউশনের সঙ্গে দীর্ঘ তর্কের পর পরবর্তী প্রশ্নে এগিয়ে যান মিজানুর রহমান। এ মামলায় সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিনা জানতে চান তিনি। জবাবে না বলেন আবজালুল। তবে প্রতিশ্রুতি-প্রলোভনের ভিত্তিতে নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে দাবি করেন এই আইনজীবী।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, সহিদুল ইসলাম ও সাইমুম রেজা তালুকদার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আসামি আব্দুল্লাহিল কাফীর আইনজীবী মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজসাক্ষী মূলত অপরাধী হতে হবে। অর্থাৎ অপরাধী যদি মাফ চান সেই শর্তে রাজসাক্ষী হতে পারেন। কিন্তু এই সাক্ষী (আবজাল) নিজেও আশুলিয়ায় এক পুলিশ হত্যা মামলার আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) ছিলেন। মানে ওখানে গত বছরের ৫ আগস্ট যে একজন এএসআইকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তার স্ত্রী মামলা করেছিলেন। ওই মামলারই তদন্তে ছিলেন এই রাজসাক্ষী।
ঠিক কী নিয়ে হট্টগোল হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা সবকিছুতে বাধা দিতে চান। তাদের মনমতো করে চললে আর বাধা দেয় না। মতের বাইরে গেলে বাধা দেওয়া হয়। সাধারণত রাজসাক্ষী হলো কেস অব নো এভিডেন্স। অর্থাৎ যে মামলা প্রমাণ করতে পারছে না। প্রমাণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতা আছে সেই জায়গায় কাউকে প্রলোভিত করে রাজসাক্ষী করা হয়।
আশুলিয়ায় ছয়টি লাশ পোড়ানো হয়েছিল সত্য জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, হত্যার পর পুড়িয়ে ফেলায় তাদের চেহারা বিকৃত করা হয়েছে। পুলিশের গাড়ি পোড়ানো হয়েছে এটাও সত্য। মূল প্রশ্ন হলো করলোটা কে। সেখানে পুলিশের লাশও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেন মিজানুর রহমান।
গতকাল বুধবার এ মামলায় ২৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে মুখ খোলেন আবজালুল। রাজসাক্ষী হয়ে পুরো সত্য উদঘাটনের কথা ছিল তার। তবে অনেক কিছুই যেন চেপে রেখেছেন তিনি। ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে বহু তথ্য সামনে আসেনি বলেও মিশ্রপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যদিও রাজসাক্ষী হিসেবে নিজের জানা সবকিছুই প্রকাশ করেছেন বলে দাবি প্রসিকিউশনের।
চলতি বছরের ২১ আগস্ট এ মামলায় ১৬ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। ওই সময় উপস্থিত আট আসামির সাতজনই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তবে দোষ স্বীকার করেন এসআই শেখ আবজালুল হক। একইসঙ্গে রাজসাক্ষী হতে চেয়ে মামলার ব্যাপারে যা জানেন সব আদালতের কাছে বলতে চেয়েছেন। পরে তার দোষ স্বীকারের অংশটুকু রেকর্ড করা হয়। একইসঙ্গে লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজসাক্ষী হওয়ার অনুমতি পান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইবুনালে সাক্ষ্য দেন আবজালুল।
এ মামলায় গ্রেপ্তার আট আসামি হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, আবজাল ও কনস্টেবল মুকুল। তবে সাবেক এমপি সাইফুলসহ আটজন এখনও পলাতক রয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ছয় তরুণ। এরপর পুলিশ ভ্যানে তাদের লাশ তুলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নৃশংস এ ঘটনার সময় একজন জীবিত ছিলেন। কিন্তু তাকেও বাঁচতে দেননি তারা। পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত মানুষকেই পুড়িয়ে মারা হয়। এ ঘটনায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়। এরপরই দীর্ঘ তদন্ত শেষে এখন সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী মাসের মাঝামাঝিতে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে প্রসিকিউশন।
এমআরআর/এসএম