সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়া পিকে হালদারের ‘সহযোগী’ ২৫ জনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে হাইকোর্টের আদেশ শুধু সাবেক সচিব এন আই খানের ক্ষেত্রে স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত।

রোববার (২৪ জানুয়ারি) আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী এই আদেশ দেন।

আদালতে এন আই খানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মেহেদী হাসান চৌধুরী। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।

গত ৪ জানুয়ারি পিকে হালদার কাণ্ডে সাবেক সচিব এন আই খানসহ ২৫ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। এই ২৫ জনকে প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশন জিজ্ঞাসা করতে পারবে বলেও আদেশে বলা হয়।

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

পরে এই আদেশ স্থগিত চেয়ে এন আই খানের পক্ষে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়।

সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়া পিকে হালদারের প্রতারণায় সহায়তাকারী ২৫ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে ভূক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা।

এই ২৫ জন হলেন- প্রতি সপ্তাহে পিকে হালদারের সঙ্গে যোগাযোগকারী হারুনুর রশিদ (ফাস ফাইনান্স), উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সামি হুদা, অমিতাভ অধিকারী, অবন্তিকা বড়াল, শামীমা (ইন্টারন্যাশনাল লিজিং), রুনাই (ইন্টারন্যাশনাল লিজিং), এন আই খান (ইন্টারন্যাশনাল লিজিং), সুকুমার মৃধা (ইনকাম ট্যাক্স আইনজীবী), অনিন্দিতা মৃধা, তপন দে, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, অভিজিৎ চৌধুরী, রাজিব সোম, ইরফান উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (সাবেক এমডি ব্যাংক এশিয়া), অঙ্গন মোহন রায়, নঙ্গ চৌ মং, নিজামুল আহসান, মানিক লাল সমাদ্দার, সোহেল সামস। এছাড়া পিকে হালদারকে বিভিন্নভাবে তথ্য দিয়ে সহযোগিতাকারী চারজন হলেন- মাহবুব মুসা, এ কিও সিদ্দিকী, মোয়াজ্জেম হোসেন ও লিলাবতী হালদার (পিকে হালদারের মা)।

গত ৩ জানুয়ারি পিকে হালদারের প্রতারণার শিকার সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়েসহ ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা রুল শুনানিতে পক্ষভূক্ত হন।

ওইদিন পিকে হালদারের প্রতারণার শিকার সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়েসহ ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা আত্মসাৎ করা টাকা ফিরিয়ে দিতে আদালতের কাছে আকুতি জানান। তারা উচ্চ আদালতকে বলেন, ‘আর্থিক ও মানসিক কষ্টে আমরা মারা যাচ্ছি, আমাদের বাঁচান।’

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পিকে হালদার জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। যার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হতে বসেছে এবং গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এসবের মধ্যেই পিকে হালদার গোপনে দেশ ছাড়ে। একপর্যায়ে পিকের বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনা ও তার গ্রেপ্তারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চান উচ্চ আদালত। 

এদিকে পিকে হালদারের বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি হয়েছে জেনে হাইকোর্টের কাছে নিজেদের সীমাহীন কষ্টের কথা বলতে দুদক আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩ জানুয়ারি দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান হাইকোর্টকে বলেন, পিপলস লিজিংয়ের কয়েকজন আমানতকারী কিছু বলতে চান। একপর্যায়ে অনুমতি নিয়ে হাইকোর্টে নিজেদের দুর্দশার কথা বলেন চার আমানতকারী।

সামিয়া বিনতে মাহবুব নামের এক আমানতকারী অশ্রুসিক্ত নয়নে হাইকোর্টকে বলেন, ‘মাই লর্ড, আজ আমি একজন ক্যানসারের রোগী। আমার এখন আর চাকরি নেই। করোনা আসার পর থেকে আমার স্বামীরও চাকরি নেই। আমি আর আমার স্বামী মিলে আমাদের জীবনের কষ্টার্জিত টাকা পিপলস লিজিংয়ে আমানত রেখেছিলাম। এখন আমরা আমাদের টাকা পাচ্ছি না! এতটা অসহায় হয়ে গেছি যে, এবার বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারিনি। গত ১ বছর বাচ্চাদের একটু মাছ- মাংস খাওয়াতে পারিনি। আমরা আর্থিক-মানসিক কষ্টে মারা যাচ্ছি। আমরা এখন কার কাছে যাব? মাই লর্ড, আপনাদের কাছে আকুল আবেদন, আমাদের বাঁচান।’

একপর্যায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের মেয়ে ড. নাশিদ কামাল হাইকোর্টকে বলেন, ‘মাই লর্ড, আমার বাবা এবং আমিসহ পরিবারের ৫ জন পিপলস লিজিংয়ে টাকা আমানত রেখেছি। আমরা সরল বিশ্বাসে আমাদের টাকাটা রেখেছিলাম। আমরা গণমাধ্যমে জেনেছি পিকে হালদার এখান থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং। তাই এখানকার আমানতকারী হিসেবে আমি আমরা আমাদের টাকাটা ফেরত চাই।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মো. শওকতউর রহমান হাইকোর্টকে বলেন, ‘মাই লর্ড, দেশটা কি স্বাধীন করেছিলাম এভাবে নিজে প্রতারিত হওয়ার জন্য? আমি আমার আমানতের টাকাটা ফেরত চাই।’

বিনিয়োগকারীদের এসব কথা শুনে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলের শুনানিতে তাদের পক্ষভুক্ত করে নেন।  

এমএইচডি/জেডএস