দিলারা জামান। দেশের কিংবদন্তি অভিনেত্রী। সুদীর্ঘ সময় ধরে অভিনয়শিল্পের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার অভিনীত প্রথম নাটক ‘ত্রিধরা’ দর্শক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৯৪ সালের হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত বাংলা সিনেমায় আগুনের পরশমণি ছাড়াও চাকা, চন্দ্রগ্রহণ, বৃহন্নলাসহ অনেক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন এবং অসংখ্য ধারাবাহিক, সাপ্তাহিক নাটকে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে তাকে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধুর মা হিসেবে। নারী দিবস ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেশের এই প্রখ্যাত অভিনেত্রী কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাফিন

১৯৬৬ সালে ত্রিধরা নাটকের মধ্য দিয়ে আপনার অভিষেক হয়। যতটুকু জানি তখনকার সময় নারীরা খুব রক্ষণশীলতার ভেতরে থাকতেন। আপনি এই বিষয়টিকে কীভাবে অতিক্রম করলেন?

-হ্যাঁ ওই সময়ে মেয়েরা ঘর থেকে বের হতে পারত না, এরকম পরিস্থিতি ছিল। তবে আমার বাবা অনেক সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন, আমাকে তেমন বাধা দেননি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই নাটক করেছি। আমার এখনো মনে আছে, আলাউদ্দিন আল আজাদের মায়াবী প্রহর নামে একটি নাটক করেছিলাম, ডাকসুর নাটক ছিল আর কী! আবদুল্লাহ আল মামুন, ড. এনাম আমরা সবাই মিলে নাটক করেছিলাম। আমার বিয়ে হয়েছে ১৯৬৪ সালে ফখরুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনিও খুব সংস্কৃতিমনা, উদার মনের মানুষ ছিলেন। তাদের সাহায্য আমি এগোতে পেরেছি, তা না হলে হয়তো সম্ভব ছিল না।

প্রথম নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? 

- আমার আজকেও মনে হচ্ছিল নাটকটির কথা। আমাদের মা হয়েছিল শহীদ মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী। যতগুলো ইন্টারভিউ দিয়েছি, সবসময় তার কথা স্মরণ করি। কারণ তখনকার সময় টেলিভিশন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব নাটক হতো, সেখানে তিনি অভিনয় করেছেন। মুনীর চৌধুরী স্যার উদার মনের, স্বাধীন চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল।
 
নারী দিবস প্রতি বছর আসে যায়। আমরা উদযাপনও করি, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? আপনার কী মনে হয়?

- হ্যাঁ কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এখনও মেয়েরা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, শহরকেন্দ্রিক যারা শিক্ষার আলো পেয়েছে, তারা সুযোগ সুবিধা বেশি পায়। অধিকারও ভোগ করে। কিন্তু আমরা যখন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাই, তখন দেখি একেবারেই নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী যেসব নারী আছে এখন পর্যন্ত নানা বৈষম্যে ভুগছেন তারা। সে বৈষম্যগুলো খুবই প্রকট। সভা, সেমিনার না করে প্রকৃত যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। আর যারা এগুলো নিয়ে কাজ করেন, তারা যেন অরেকটু সক্রিয় হন, তাহলেই কিন্তু নারী দিবস সফল হবে।


 
জাতিসংঘ গত ২৫ বছর নানা প্রতিপাদ্য বিষয় দিয়ে আসছে, কিন্তু কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?

-সফলতা তো কিছুটা পেয়েছেই। তবে আমাদের সমাজে নারীরা বিশেষ করে নিম্নবিত্ত শ্রেণির, তারা সকল বাধা ভেঙে, সকল শিকল ভেঙে রাস্তায় নামে কাজের জন্য। ছেলেরা যে কঠিন পরিশ্রম করে, সেগুলো পর্যন্ত তারা এখন করছে। ইট ভাঙছে, পাথর বোঝাই টুকরি মাথায় নিয়ে ছেলেদের মতো সমানভাবে কাজ করছে। কিন্তু তাদের যে পারিশ্রমিক, সেটি সমানভাবে পাচ্ছে না। তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। জাতিসংঘ হোক, শ্রম অধিকার হোক, শ্রমিক নেতা হোক, তাদের কাছে আমি বিশেষ অনুরোধ জানাব মানবিক দিক থেকে এবং ন্যায়ের কথা চিন্তা করে হলেও তারা যেন এই দিকটা খেয়াল রাখে।
 
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী হতে পারে?

- পরিত্রাণ তো আসলে এক কথায় বলা সম্ভব না। প্রযুক্তিগত কারণে মানুষ খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেখান থেকে ফিরতে হবে। প্রচুর বই পড়তে হবে। আগে পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি ছিল, এখন সেসব বই- লাইব্রেরি দেখা যায় না। সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমগুলো খুলে দিতে হবে। বাবা-মা বা অন্যরা তাদের সঙ্গে শিশুর যে বেড়ে ওঠা, তা সহজ করে দিতে হবে। আমরা এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি সে ব্যস্ততা শিশুর সঙ্গে না দেখানো, মনোজগতের যে বিকাশ, সেগুলোকে খুলে দিতে হবে বলে আমি মনে করি। সত্যিকার অর্থে যে শিক্ষার আলো তারা পাচ্ছে না, সেটি ছড়িয়ে দিতে হবে। একটি গাছকে আমরা যেভাবে যত্ন করি, ঠিক সেভাবে একটি শিশুকে তৈরি করতে পারলে ধর্ষণমুক্ত একটা নতুন প্রজন্ম পাব বলে আমি মনে করি। 
আমাদের সমাজে এখনো মেয়েরা স্কুলে যেতে নানা সমস্যায় পড়ে, বখাটেরা তো আছেই। খেয়াল করলে দেখবে একটি মেয়ে যখন নির্যাতিত হয়, তখন মেয়েটাই নির্যাতিত হয়, আবার দোষটাও তার ঘাড়ে চাপিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু যে নির্যাতন করল সে আড়ালেই রয়ে যায়। আমাকে এখনো বলা হয় বয়স হয়েছে, হজ করেছেন, আর কত? আমি যেমন এগুলোতে কান না দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, সবাইকে তেমন এগিয়ে যেতে হবে।
 
নারী দিবস হোক আর নারী দিবসের বাইরে হোক, নারী কীভাবে আরো বেশি সোচ্চার হতে পারে, এ ব্যাপারে যদি কিছু বলতেন।

নারী এখন অনেক সোচ্চার। আমি বলব তারা এখন খুব প্রতিবাদী হওয়ার সাহসও পাচ্ছে।  আগে একটা কিছু ঘটলে কোনো মেয়েই সাহস পেত না থানায় গিয়ে নালিশ করার, এখন কিন্তু করছে। এখন সে ভয় পায় না। কাউকে না পেলে একাই যায় অথবা কোনো একটি পত্রিকার সাহায্য নেয়। এগুলো আমাকে আলোড়িত করে। এভাবে চলতে থাকলেই নারীরা এগিয়ে যেতে পারবে। 

 আপনার প্রিয় নারী কে বা কারা?

- বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে যাদের জীবন দেখে, যাদের কর্ম দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি, সবাই আমার কাছে স্মরণীয়। যাদের আদর্শে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করেছি, তারা সবাই আমার প্রিয়।


 
প্রিয় অভিনেত্রী কে, আপনি কখনো কাউকে অনুসরণ করেছেন কি না? 

- আসলে অনুসরণও সবাইকে করি। শেখার তো শেষ নেই। অভিনয় এমন কিছু, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শিখতে হবে বলে আমি মনে করি। এখন নতুন কেউ অভিনয়ে এলেও আমার মনে হয় তার অনেক প্রতিভা, তার কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। শেখার ব্যাপারে কখনো কুণ্ঠাবোধ করি না।

এখনকার অভিনেত্রীদের মধ্যে কাকে পছন্দ করেন?

- সবাইকে পছন্দ করি। আগে তো অভিনয়টা শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে। অনেক বেসরকারি সংস্থা শেখাচ্ছে। আমাদের তো জানার কোনো পথই ছিল না যে কোথাও থেকে শিখব বা জানব। এরা তো শিখে আসে। ভালো করছে, ভালো করবে। চর্চা এবং সৎ থাকলে এরা অনেক ভালো করবে। না হলে আসবে-যাবে, আবার হারিয়ে যাবে।
 
আগের থেকে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরেও আগের মতো তারকা অভিনেত্রী তৈরি হচ্ছে কম। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

- না না। এখনো তৈরি হচ্ছে। আগে ইন্ডাস্ট্রি ছোট ছিল, তারকা কম ছিল, চোখে পড়ত। এখন ইন্ডাস্ট্রি এত বড় যে তারকা চোখে পড়ে না। এখনো অনেক প্রতিভাবান ও মেধাবী অভিনেত্রী তৈরি হচ্ছে এবং এ কথা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করব।

ঢাকা পোস্টের পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলুন-

- আপনারা ভালো থাকবেন। এত রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন দেশ, যে পতাকা আমরা পেয়েছি, সে দেশকে যেন আমরা সবাই ভালোবাসি। পতাকা হলো আমার পরিচয়, এ পরিচয়টাকে যেন আমরা সম্মানের সঙ্গে বহন করতে পারি। বঙ্গবন্ধু বায়োপিকে আমি মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছি। আমার জন্য দোয়া করবেন। আর ঢাকা পোস্টের সঙ্গেই থাকবেন।