তারুণ্যে ঈদ আনন্দ
ঈদ সবার প্রাণের উৎসব। কিন্তু ঈদ নিয়ে যেন তরুণদের ভেতর একটু বেশিই আগ্রহ থাকে, থাকে অন্যরকম ভাবনা। ঈদের সময় শহর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘরে ফেরে হাজার হাজার তরুণ। ঈদকে ঘিরে থাকে তাদের নানাবিধ পরিকল্পনা, আনন্দ আয়োজন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈদ উদযাপনেও এসেছে কিছুটা পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে শিশু, কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ সবার ক্ষেত্রেই। চলুন জেনে নেয়া যাক ঈদ সম্পর্কে বর্তমান তরুণদের ভাবনা-
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী সালমান সাদ বলেন, স্বাভাবিক আর দশটা ছুটির দিনের মতোই মনে হয় এখন ঈদের দিনটিকে। এই মনে হওয়াকেই সম্ভবত বড় হয়ে যাওয়া বলে, জীবন থেকে শৈশব আর কৈশোরের রঙিন মখমলি দিন মুছে যাওয়া বলে। আমি আজন্ম নাগরিক। ঘরফেরা মানুষেরা যখন পঙ্গপালের মতো বাস-ট্রেন-লঞ্চে, শান্ত ধলেশ্বরীর বুক চিরে, গ্রামীণ সবুজ মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে পৌঁছে যায় নিজ বাড়ির স্নিগ্ধ শান্তিমাখা আঙিনায়- তখন শূন্য নগরী আমাকে প্রশ্ন করে, তোমার ফেরার ঘর কোথায়? ঈদে তেমন কোনো স্মৃতি না থাকার আরও একটি কারণ হতে পারে স্বরচিত নির্জনতায় বসবাস। আমরা বই-বাহিক জীবন যাপনের মানুষ, মানুষের উল্লাস-উৎসবের চেয়েও বড় কোনো বিপন্ন বিস্ময় হয়তো মননে মগজে সবসময় খেলা করে। অতোটা প্রকাশিত হওয়ার চেয়ে বরং মানুষের গ্রামে শহরে সমাজে এই সামগ্রিক যে আনন্দ ঈদকে ঘিরে, তার রঙ বা আলোটাই হয়ত বুঝতে চাই চুপ করে। ঈদ তবুও নানামাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে থাকে। আমার কাছে নিজে খুশি বা উৎফুল্ল হওয়া বা না হওয়ার চেয়ে অন্যকে, প্রতিটি মানুষকে খুশি দেখতে চাওয়াটাই ঈদ। এই দিনটায় অন্তত কারো কষ্টের কোনো স্মৃতি না জমুক। মানুষ প্রতিশোধ না নিয়ে হাসিমুখে মানুষকে বুকে জড়িয়ে বলুক, ঈদ মোবারক! শান্তি সম্প্রীতি ও সমতার বার্তা যদি ঈদ প্রাণে প্রাণে বইয়ে দিতে পারে, এই অস্থির সময়ে এইটুকুই বা কম কী স্বস্তির!
বিজ্ঞাপন
ইডেন মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাবিহা ইয়াসমিন প্রীতি বলেন, ঈদ বলতেই আনন্দ। ছোটবেলায় ঈদ বলতে আমরা বুঝতাম নতুন জামা, দু’হাত ভরে মেহেদি লাগিয়ে এলাকার ছোট-বড় সবাই একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, বড়দের সালাম করে সালামি নেয়া, বাসায় ভালো-মন্দ খাবার খাওয়া, একে অন্যের বাসায় ঈদের দাওয়াত। পরিবার, বন্ধু বান্ধব, প্রিয়জন সবার সঙ্গে ঈদের সময়গুলো দারুণভাবে কেটে যাওয়ার এক আবেগঘন মুহূর্ত। সময়ের সঙ্গে অনুভুতি বদলায়, মানুষ বদলায়, ব্যস্ততা শুরু হয়। এখন ঈদ বলতে পরিবারের সবাই একসঙ্গে হওয়া, সবাই মিলে সুন্দর কিছু মুহূর্ত ভাগাভাগি করা। একসাথে খাওয়া দাওয়া আর আত্মীয়-স্বজন সবার সঙেবগ আনন্দঘন মূহুর্ত তৈরি করা। এক মাস রোজা রেখে আমরা মুসলমানরা ঈদের আনন্দের জন্য অপেক্ষা করি। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, প্রিয়জন সবার সঙ্গে ঈদের আমেজ ভাগাভাগি করার এই অনুভূতি সুন্দর। সারাবছর বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় পার করার পর বছরের এই দিনে এসে সবাই একসঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার এই মূহুর্ত সুন্দর। তবে হ্যাঁ ছোটবেলার ঈদগুলো বেশি সুন্দর ছিল। ঈদ কার্ড, নতুন জামা, চাঁদ রাতে দু’হাতে মেহেদি দিয়ে বসে থাকা, সকালে আম্মুর হাতে সেমাই হালুয়া দিয়ে ঈদের দিনগুলো শুরু হতো। সে অনুভূতি গুলো অনেক বেশি সুন্দর।
তেজগাঁও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ ফারাবী বলেন, আমাদের ঈদ অনেকটাই রঙিন। এখনো ছোটদের মতো মজা করি ঈদের দিনে। আম্মুকে লম্বা করে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। একশো টাকার চকচকে একটা নোট বের করেন উনি স্টিলের আলমারি থেকে। তা নিয়েই ভাই-বোনেরা কাড়াকাড়ি করি। ধোঁয়া ওঠা গরম দুধে আম্মু লাচ্ছা সেমাই ঢেলে দেন। তা খেয়ে ঈদের জামাতে যাই আমরা। আমাদের বাড়িটা অনেক বড়। বড়-ছোট মিলে প্রায় পনেরোটা পরিবার থাকে। আমরা ঈদের নামাজ শেষে সবাই সবার ঘরে গিয়ে সালাম বিনিময় করি। ছোটদের ঈদ সালামি দিই। বড় হয়ে যাচ্ছি, তবে ঈদকে এখনো চুরি হয়ে যেতে দিইনি। যতদিন বেঁচে আছি, ঈদটাকে নিজের কাছেই রেখে দিতে চাই।
বিজ্ঞাপন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্তিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী বারিশ লিয়ানা মীম বলেন, ঈদুল ফিতর মূলত রোজা ভাঙার ঈদ। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পরই শাওয়াল মাসের এক তারিখে আমরা আমাদের খুশি উদযাপন করি। ঈদকে ঘিরে আমাদের মধ্যে একটা অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করে। অবশ্য ঈদে বড়দের থেকেও ছোটরা বেশি আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। নতুন কাপড়, জুতা, কসমেটিকস এবং বিভিন্ন কিছু কেনার ক্ষেত্রে তাদেরই প্রবল আগ্রহ দেখা যায়। এক আত্মীয় থেকে আরেক আত্নীয়ের বাড়িতে ছোট-বড় সবার জন্যই কোনো না কোনো উপহার সামগ্রী পাঠানো হয়। ঈদের দিনে ঈদ সালামির একটা প্রচলন রয়েছে। এই সময়ে ছোটরা বড়দের কাছ থেকে সালামি হিসেবে টাকা এবং দোয়া আবদার করে থাকে। এভাবেই, নানানরকম আনন্দের মধ্য দিয়ে আমাদের ঈদ উদযাপিত হয়ে থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাজলিন মেহজাবিন চৌধুরি বলেন, ঈদ! ছোট্ট দুটি অক্ষরের একটি শব্দ। অথচ এই শব্দ কানে এলেই মন ছেয়ে যায় আনন্দে। কিন্তু সেই ছোটবেলার আনন্দ কি পাওয়া যায়? সেই ঈদ সালামি, বাবা-চাচার হাত ধরে ঘুরতে যাওয়া, নতুন জামার আনন্দ এসব ফিকে হয়ে আসে সময়ের বদৌলতে। তারুণ্যের ঈদে যেন ভর করে একরাশ দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধ। কোনভাবেই আর ফিরে যাওয়া যায় না সেই ছোট্টবেলায়। আমরা ফিরে না গেলেও সেসব শিশুদের কিন্তু ঈদের প্রকৃত আনন্দ দিতেই পারি, যারা সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। একটি নতুন ঈদের জামা কিংবা ঈদের বিকেলে তাদের সঙ্গে একটুখানি সময় কাটানো তাদের দিতে পারে অসীম আনন্দের সমাহার।
রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফিরোজ হোসাইন বলেন, ঈদ সবার জন্যই কমবেশি আনন্দের উৎসব। তবে গত তিন বছর ধরে ঈদ আমার জন্য বিশেষ দিন নয়। কারণ এই তিন বছর ধরে পরিবার থেকে দূরে আছি। রমজানের ত্রিশ রোজা, নামাজ ঠিকঠাক পালন করা হলেও, ঈদ আমাকে আর আকর্ষণ করে না। একটা সময় ঈদ ঘিরে গ্রামে নানা আয়োজন হতো, গ্রামের বন্ধুরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতাম, নতুন কাপড় পরতাম। নিজের বাড়ি থেকে বন্ধুদের বাড়িতে খাবার খেতাম বেশি। দাওয়াত পেতাম বিভিন্ন বাড়িতে। আবার, দুই তিন গ্রাম মিলে বিশেষ টুর্নামেন্ট দিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন হতো। ঈদের বিশেষ আকর্ষণ বলতে আমাদের সবার এই টুর্নামেন্টে চোখ থাকতো। দারুণভাবে কয়েকটা দিন পার হতো। সেসব এখন পুরনো অতীত অথবা কাঁচের ছবি। আজকের ছেলেরা মাঠ ছেড়ে ফোনে ডুবেছে। তাই সেসব আয়োজন আমার গ্রামে আর চোখে পড়ে না। তবে আমরা সবাই একত্রিত হলে চেষ্টা করি আয়োজন করতে। কখনো কখনো আয়োজন সম্ভব হয়ে ওঠে, আবার কখনো হয় না। বন্ধুদের যুক্তি-তর্কে হারিয়ে যায় সময়, অতঃপর আয়োজন। ঈদ এখন মা-বাবা, পরিবারকে ঘিরে। মন চায় ছুটে যাই তাদের কোলে। এই রমজানের ঈদ আমাকে বিশেষভাবে টানছে। বেঁচে থাকলে এবার বন্ধুদের সাথে মিলিত হবো দীর্ঘ সময় পর আর গেয়ে উঠব সবুজের গান।
ঈদ আগেও রঙিন ছিলো, এখনো রঙিন। সময়ের পরিক্রমায় তার রঙ বদল হয়েছে মাত্র। সময়ের হাত ধরে আমরাও যেন ঈদ আনন্দকে সবসময় ভাগাভাগি করে নিতে পারি, ঈদের খুশিকে ছড়িয়ে দিতে পারি সবার মাঝে, সেটাই হোক তরুণ সমাজের অঙ্গীকার।