ছবি: প্রতীকী

‘নাবিল এই বলটা লাইনে কর ভাই, তাহলেই জিতে যাবো’ পাশ থেকে এক বন্ধু বলছিল। আমি বল করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি অমনি শুনি ‘সবাই পালা, পালা নাবিলের আব্বু আসতেছে বেত নিয়ে’।

ঘটনা এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে, কোচিংয়ের ক্লাস শেষের দিকে। সেসময় ক্লাস বাদ দিয়ে খেলতে যাওয়ার পরিণাম পেয়েছিলাম বাবার বেতের আঘাতে। কিন্ত আমিও জেদী, পরীক্ষা হোক আর যাই হোক খেলাধুলা কিছুতেই ছাড়া যাবে না। ফলে বাবা-ছেলের প্রায়শই এমন মনোমালিন্য আশেপাশে সবারই জানা ছিল।

এসব ঘটনা নিয়ে একসময় খুব রাগ হতো। মনে হতো, খোদা বুঝি ভুল করে এই বাড়িতে পাঠিয়েছেন যেখানে পড়াশোনা ছাড়া কেউ কিছু বোঝে না বা বুঝলেও কিছু করতে চায় না। সারাদিন স্কুল-কোচিং শেষে বাসায় দম ফেলার ফুসরত নেই, আবার বাপের পাশে বসে রাত পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করা ছিল নিত্যদিনের রুটিন। অন্যান্য বন্ধুরা যেখানে রাত-বিরাতে বাইরে ঘুরতে বের হতো তখন আমি বসে ম্যাথ সলভ করতাম, বাবার কড়া আদেশ সন্ধ্যার পরে বাইরে যাওয়া যাবে না।

বাবার সঙ্গে সুখস্মৃতি খুব বেশি নেই, তবে টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট যখন হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম ‘দেখো, ফার্স্ট হয়েছি’, সেদিনের হাসিটা আজও মনে গেঁথে আছে। বাবারা হাসে না, বাবার হাসায়।

বাবাদের আত্মতুষ্টির বিষগুলো খুবই সাধারণ, ছেলেমেয়ে ভালো কিছু করবে, ভালো জব পাবে এতেই যেন তার সফলতা। গ্রামের আর দশটা মানুষের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের সফলতা শেয়ার করার মাঝেই বাবা শান্তি পায়। যেদিন মেডিকেলে চান্স পেলাম, সেদিন থেকে শুধু একটা কথায় কানে বাজে- ‘বেটা ভালো করে পড়বি, দরকার হলে রক্ত বিক্রি করে টাকা দেবো’। আমার জীবন হয়তো সেদিনই পূর্ণতা লাভ করেছিল। কারণ গোটা দুনিয়া আমার বিপরীতে গেলেও সেই একজন মানুষ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে বলবে- ‘বাপ রে, জীবনে আফসোস রাখবি না, দৌড়াবি শেষ পর্যন্ত, মানুষ মনে রাখবে না তোকে-আমাকে,  মনে রাখবে আমাদের কর্ম’।

আজ চোখের সামনে যখন এই মানুষটা বয়সের ভারে নত হয়ে যাচ্ছে, সাথে সঙ্গ দিতে দুরারোগ্য ব্যাধিরা অপেক্ষামান, সেই অনুভূতি আসলে খুবই কষ্টকর। এগিয়ে যাক জীবন, ভালো হোক কর্ম আর শান্তিতে থাকুক প্রতিটি বাবা।

রংপুর মেডিকেল কলেজ।