সন্ধ্যার আকাশে বন্ধুকে খুঁজি
ছবি: প্রতীকী
তখন আমি ক্লাস সেভেনে। গ্রাম থেকে মফস্বলের স্কুলে এসে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে কিছুটা সময় নিতে হয়েছিল আমার। শহরের স্কুলে মানিয়ে নিতে গিয়ে টের পেলাম, দুই-একজন ছাড়া বাকিদের তুলনায় গড়নের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে আছি। কাছাকাছি যে দুই-একজন ছিল, তাদের সঙ্গে খুব একটা বোঝাপড়া হচ্ছিল না। সেদিক থেকে জাহিদ অনেকটা আলাদা আর চুপচাপ স্বভাবের। ওর পুরো নাম জাহিদ উদ্দিন খান। ক্লাসে গিয়ে বসলাম, এমন সময় সে এসে হাজির। পাশের সিটটা খালি ছিল, সেখানেই এসে বসলো। আমার পাশে বসে সেদিন সহজ সুন্দর হাসি দিয়ে বেশ আলাপ জুড়ে বসেছিল। আমিও বেশ মজাই পাচ্ছিলাম তাতে।
প্রথমদিনের খুব একটা স্মৃতি মনে নেই। তবে এরপর ক্লাসে রীতিমতো পাশের সিটটা ওর দখলেই ছিল। বরাবরই একটু পড়াশোনা বিমুখ ছিলাম আমি। কিন্তু জাহিদ প্রতিদিন এসে ক্লাসের ফাঁকে গল্প, উপন্যাস, কবিতার আলাপ শুরু করে দিতো। মাঝেমধ্যে দেখা গেছে ক্লাস চলাকালীনই আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্লাস চলাকালীন এই কথার বলার অভ্যাসটা নিয়ে বেশ বিরক্ত হতাম কিন্তু সরাসরি তাকে বুঝতে দিতাম না।
বিজ্ঞাপন
এরমধ্যে সে একদিন একটা বই এনে হাতে দিয়ে দিয়ে বললো, বইটা পড়েছো? না সূচক উত্তর দিলাম। বিপরীতে সে বললো, বেশ মজার বই। পড়ে শেষ করে আমাকে দিয়ে দিয়ো, সময় বেঁধে দিলো এক সপ্তাহ। ওর কথা শুনে রীতিমতো ভ্রু কুঁচকে গেল! ক্লাসের পড়াই তো পড়তে ইচ্ছা করে না, তার উপর এই বই! ওকে খুশি করার জন্য একটা হাসি দিয়ে বললাম ঠিক আছে, পড়বো। সপ্তাহ গড়িয়ে দিন বিশেক পার হয়ে যাওয়ার পর সে বইটা চেয়ে বসলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, বইটা পড়েছিলাম কি না। ওকে খুশি করার জন্য বললাম, পড়েছি। কিন্তু বিপরীতে সে এমন চেপে ধরবে বুঝে উঠতে পারিনি। পরে আরও এক সপ্তাহ সময় বাড়িয়ে দিয়ে বললো, বইটা পড়ে আমাকে জানাবে।
বইয়ের নাম ছিল পাগলা দাশু। সুকুমার রায়ের সেই বই দিয়েই শুরু, এরপর একে একে সুকান্ত, জীবনানন্দের লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো সে। ধীরে ধীরে কখন যে বইয়ের প্রতি একটা টান তৈরি হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারিনি। জাহিদকে যতটা সহজ-সরল, শান্ত স্বভাবের ভেবেছিলাম, ওর মধ্যে ঠিক উল্টোটাও দেখতে পেলাম আস্তে আস্তে। দেশ, শিক্ষা, সরকার, রাজনীতি, বিশ্ব-অর্থনীতি থেকে শুরু করে পৃথিবী কিংবা মহাকাশ নিয়েও আলোচনা এসে যেত তার গল্পে। ওর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা স্পষ্ট হয়ে যেত কথাবার্তায়। ক্লাস নাইনে ওঠার পর চে গুয়েভারাকে তার গল্পেই চিনেছিলাম। স্কুলের বাইরে আমরা বেশ আড্ডা জমাতাম। মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে সে আমার বাসায় আসতো। মায়ের সঙ্গে একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
ক্লাস নাইনে আমাদের গ্রুপ হয়ে গেল আলাদা। কমন ক্লাসগুলো বাদে ওর সাথে তেমন দেখা হতো না। ক্লাসের বাইরেও তেমন আড্ডা আর হতো না। স্কুল শেষ করে আর একই কলেজে পড়া হয়নি আমাদের। জাহিদের সঙ্গে সেখান থেকে অল্প-স্বল্প দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে গেলাম ঢাকায়। জাহিদ ছিল মফস্বলেই। মাঝেমধ্যে সে বাসায় গিয়ে মায়ের কাছে আমার খোঁজ নিতো কিন্তু বহুদিন আমাদের দেখা হচ্ছিল না। একবার ছুটিতে এসে ওর সঙ্গে দেখা করলাম। সেই দেখায় টের পেলাম, রাজনীতি নিয়ে সে খুব ব্যস্ত। দেশ নিয়ে তার সে কী চিন্তা! ও চাইতো আমিও তাকে এই ব্যাপারে সঙ্গ দিই। সে জানালো, ঢাকায় পার্টি অফিসে সে মাসে দুই একবার যাতায়াত করে। ঢাকায় গিয়ে আমার সাথে দেখা করবে। রীতিমতো এই ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলতে গিয়ে ওকেই এড়িয়ে চলা শুরু করলাম। ওর কল পেয়ে নিজেকে ওর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চাইতাম। তাতে দূরত্ব আরও বেড়ে গেল। কিন্তু সেই দূরত্ব থেকে আমাদের যে আর কখনো দেখা হবে না, সেটা ভাবিনি!
আমার বন্ধু জাহিদকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কয়েকবছর আগে। ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা জানা নেই, আর জানার চেষ্টাও করিনি। আমি চাই না, আমার সেই বন্ধুর কবর আমার চোখের সামনে আসুক। যে খবরটা সেদিন শুনেছিলাম, সেটাকে সারাজীবন মিথ্যা বলেই ধরে নিতে চাই। যতদিন বেঁচে থাকবো সন্ধ্যার আকাশে খুঁজে যাবো আমার সেই বই আর গান প্রিয়, সুন্দর মনের বন্ধুকে।