বন্ধুকে বলো না বিদায়
অন্ধকারে একজন বন্ধুর সঙ্গে হাঁটা, আলোতে একা হাঁটার থেকেও ভালো। বন্ধুত্বের মর্যাদা এবং প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে প্রখ্যাত মার্কিন লেখক ও মানবতা কর্মী হেলেন কেলার এমনটাই বলে গিয়েছেন। বন্ধুত্ব একটি চিরন্তন, সার্বজনীন বিষয়। যেকোনো বয়সে যে কারও সঙ্গেই এমন মধুর সম্পর্ক ঘড়ে উঠতে পারে, যেখানে ধর্ম বর্ণ জাতি গোষ্ঠী বয়স- কোনো কিছুরই ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়।
প্রায় সবারই কম বেশি বন্ধু থাকে। বন্ধু হওয়ার এই যাত্রাটা শুরু হয় মূলত স্কুলের প্রথম দিন থেকেই। একই বেঞ্চে বসা, কলম পেন্সিল ভাগাভাগি করতে করতে নাম ঠিকানা জানতে চাওয়া, আর এভাবেই একদিন দুইদিন করে খুব নিরবে মনের অজান্তেই একজন আরেকজনের হৃদয়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। পরের দিন স্কুলে এসে ঠিক ওই বন্ধুর সঙ্গে দেখা না হলে মন খারাপ হয়। রক্তের সম্পর্কের বাইরে এটাই বোধহয় সবথেকে মধুর সম্পর্ক।
বিজ্ঞাপন
এভাবে শৈশব থেকে কৈশোরে এসে এই সম্পর্কটা আরেকটু পরিণত হয়। যুক্ত হয় প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে নানান খুনসুটি, খেলাধুলা, কখনো আবার কিছুটা রাগ-অভিমান। কৈশোরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয় সবথেকে বেশি রোমাঞ্চকর। হাজারো দুষ্ট-মিষ্টি স্মৃতি জমা পড়ে এই বয়সে। হৈ-হল্লা করে দলছুটের মত মাঠে প্রান্তরে নেচে গেয়ে আনন্দ উপভোগ করে কৈশোরের বন্ধুরা। দুই বন্ধু মাঠের এ পাশ থেকে ওই পাশে দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তারপর নিস্পাপ দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে আকাশের সীমানা পরিমাপ করতে করতে বলে, বলতো এখান থেকে আকাশ কত দূর?
যৌবনে এসে এ সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়, যুক্ত হতে থাকে বিশ্বাস এবং দায়িত্ববোধ। একজনের বিপদে আরেকজন নিঃস্বার্থভাবে ঝাঁপিয়ে পরার সাহস তৈরি হয় এই পর্যায়ে। আবার জীবনের নানা প্রয়োজন আর পরিস্থিতিতে একজন আরেকজনকে ছেড়ে থাকতে হয় যোজন যোজন দূরত্বে। অবশ্য ভালো বন্ধুত্বের বেলায় এই দূরত্ব কেবলই শারীরিক। সম্ভবত এ কারণেই শেক্সপিয়ার বলেছেন, কাউকে সারাজীবন কাছে পেতে চাও? তাহলে প্রেম দিয়ে নয়, বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখো।
বিজ্ঞাপন
আবার এমনও হয়, প্রতিদিন একই স্টেশন থেকে বাসে উঠে পাশাপাশি সিটে বসে গন্তব্যে যাওয়া। ভাংতি টাকা নাই দেখে একজন আরেকজনের ভাড়া শেয়ার করা কিংবা নিজের বসার যায়গাটা ছেড়ে দিয়েও একজন আরেকজনকে বন্ধুত্বের আহবান করেন। একটা সময় দৈনন্দিন আসা যাওয়ার মাঝে প্রশস্ত হতে থাকে তাদের বিশ্বাসের জায়গাটা। ধীরে ধীরে একজন আরেকজনের ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন। এভাবে কখন যে একজন আরেকজনের জীবনের একটা অংশ হয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না।
এসবের বাইরেও দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে পরিচয় ঘটে আরও নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে। একসঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে কিংবা একই অফিসে একসঙ্গে কাজ করতে করতে সহকর্মীর সঙ্গেও স্থাপিত হয় একটা ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন দেখা যায়, বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দারুণ বোঝাপড়ার ফলে পরিবারের যে কেউ হয়ে যায় একজন আরেকজনের ভালো বন্ধু। মোট কথা, যে মানুষটাকে বিশ্বাস করে নিজের একান্ত কথা বলা যায়, যে মানুষটাকে নির্ভয়ে ভরসা করা যায় কেবল সেই হতে পারে একজন প্রকৃত বন্ধু।
এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অনেকের বন্ধুর তালিকাটাও দীর্ঘ হয় যদিও অনেকে ভার্চুয়াল বন্ধুর এই তালিকায় প্রকৃত বন্ধুর তালিকা থেকে আলাদা রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাস্তবতাটা একটা সময় নির্মমভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়। নানাবিধ কারণে জীবনের এমন রোমাঞ্চকর সময় কিংবা প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে জীবনের শেষ পর্যন্ত পথচলা থমকে যায়। চাকুরি, সংসার, পরিবারের দায়িত্ববোধ এমন অসংখ্য জটিল শব্দের বেড়াজালে অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়। জীবনের জটিল সমীকরণ মেলাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে একটা সময় হয়তো ভাবে, আবার যদি বন্ধুদের সাথে সেই ছোট্ট বেলায় ফিরে যেতে পারতাম! তাই আজ বন্ধু দিবসে জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী সায়ানের মতো আমিও বলি- ‘কোনো শত্রুরও যেন প্রাণের এমন দূরে না যায়, শোনো বন্ধু কখনো কোনো বন্ধুকে বলো না যেন বিদায়।’