'সেরা দশ গল্প'
'সেরা দশ গল্প' না হয়ে বাড়িয়ে যদি সেরা বারো করা যায় তাহলে ভালো হয়। এমন মনে হয়েছিল এক আধবার। কিন্তু জানি, বারো করলে তখন তের-চৌদ্দরা দাবি নিয়ে আসবে। পনের করলে মনে হবে, উফ, এই ষোল নম্বর গল্পটাও তো রাখা যায়। তালিকায় ফের চোখ যাবে।
কোন একটা কি বাদ দেওয়া যায়? সম্ভব কোনো অদল-বদল। সেরা বা প্রিয় যেকোনো কিছু বাছাই সবসময়ই সমস্যার-দ্বন্দ্বের। আর সেটা যদি আবার হয় নিজেরই সৃষ্টি তাহলে যন্ত্রণা দ্বিগুণ হয়।
বিজ্ঞাপন
একটা কথা অনেকেই বলেন। নিজের সৃষ্টিকে আলাদা করা যায় না। সবগুলোই প্রিয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। নিজের খারাপ লেখা বা গল্পগুলো আমি নিশ্চিন্তে আলাদা করতে পারি। বাদ দিতে পারি। বাদ দিতে দিতে অবশ্য কখনো কখনো মনে হয়, সবই বাদ দিয়ে দেই।
সব তো আর বাদ দেওয়া যায় না তবে যেকোনো বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এই নিয়মটা কখনো অনুসরণ করি। বাদ পড়ে পড়ে যেগুলো টিকে থাকে...। বলা যায় ‘প্রসেস অব এলিমিনেশন’। ওহ হো! এই নামেও তো একটা গল্প আছে। সেটা বাদ পড়ল। থাকতে পারত। আবার ঝামেলা।
বিজ্ঞাপন
এসব ঝামেলা যার বা যাদের থাকে তাদের ক্ষেত্রে সঙ্গী বা সহযোগীর দরকার হয়। আমার ক্ষেত্রে যেমন হলো শিমুল। কবি এবং সাহিত্য সম্পাদক শিমুল সালাহ্উদ্দিন আমার লেখা থেকে তার পছন্দের গল্পগুলোর একটা তালিকা করেছিল।
খেয়াল করলাম আমার সঙ্গে বেশ মিলে যাচ্ছে। উৎসাহিত হলাম। উৎসাহ দিলাম। মিলে সেরা দশের একটা তালিকা হয়ে গেল। কিছু ক্ষেত্রে সামান্য মতানৈক্য, সেটা আবার সমন্বিত হয়ে গেল সামান্য আলোচনায়। আলাদা হয়ে গেল পছন্দের দশ।
প্রথম গল্পটা নিয়ে অবশ্য আমার কিংবা আমার পাঠকদের বেশিরভাগেরই দ্বিমত থাকবে না। দোষ বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজের পুরনো লেখা পড়তে খুব চাই না কিন্তু এই গল্পটা আমি অনেকবার পড়েছি।
একটা পালিয়ে বেড়ানো মানুষের গল্প, আসলে একটা নয়, বোধহয় অনেক মানুষের পালিয়ে চলার গল্প বা হয়তো আমাদের সবার পালানোর গল্প। এবং খুব সম্ভব যে পালায় এটা আসলে তার সমস্যা নয়, সমস্যা তাদের যারা পালায় না। থেকে যায়।
এক যুগ আগে লেখা গল্পটা নিয়ে একটা তৃপ্তি আছে, যা খুব কম লেখাতেই আমি পেয়েছি। তাই এটা সবার আগে থাকে। ‘পলাতক বীর’ তাই আমার গল্পসমগ্রের প্রথম গল্প। এখানেও শুরুতেই।
‘পিস্তলধারী পাওনাদার’ লিখেছিলাম কোনো একটা ঈদ সংখ্যায়। পরে একটা সংকলনে বোধহয় নামটা বদলেও ছিলাম। কারণ, আমার কাছে মনে হয় সেটাই সঠিক নাম।
‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’। সেকেন্ড ইন কমান্ডদের আমি খুব ভালোবাসি। মনে হয়, এরাই আসলে নাম্বার ওয়ানকে তৈরি করে। কৃতিত্ব চায় না। পাওনার দাবি নেই। আড়ালে থেকে যাওয়ার যে সংযমটুকু ওটুকুতেই তারা অনন্য। গল্প পড়ে আরও কারও কারও মধ্যে সেই ভালোবাসা সঞ্চার হতে দেখে আনন্দ পেয়েছি।
‘সালাম’ গল্পটা রাজনীতির। নিষ্ঠুরতার। আবার মানবিকতার। অনেকভাবে দেখা যায়। অনেকভাবে পড়া যায়। নানাভাবে দেখা আর পড়া যায় বলেই আলাদা মনে হয়।
রাজনীতি নিয়ে আরেকটা গল্প আছে ‘আমার ভাই তোমার ভাই।’ নামেই বোঝা যায়, আমাদের চেনা রাজনীতি নিয়ে। সেই রাজনীতির গলিপথগুলো যে কী গোলমেলে....।
‘বেকার মামা’ এবং ‘বুলেট ভাইয়ের সমিতি’ গল্পগুলো সাধারণত দৃষ্টিতে কিশোর উপযোগী। কিশোরদের লেখক হিসেবেই পরিচিতিটা বেশি, কাজেই সে রকম গল্প লিখতে হয়েছে অনেক। ক্লান্তি বোধ করিনি, কারণ কিশোর বা বাচ্চাদের নিয়ে লেখায় খেলা যায় অনেক বেশি। বাস্তব আর ফ্যান্টাসি একাকার করা যায় ইচ্ছেমতো। কিন্তু এই দুই গল্পকে ঠিক কিশোরের খাতায় ফেলা যাবে না (যাদের একজন বেকার মামা, তরুণ, বুলেট ভাইও বয়সের হিসাবে কলেজ পেরিয়ে যাওয়ার কথা), বরং এগুলো দুটো ভিন্ন মানের এবং মাত্রার মানুষকে চেনানোর গল্প। বেকারদের আমি ভালোবাসি, মনে করি সমাজের ভারসাম্যের জন্য কাজ কর্মহীন কিছু মানুষের দরকার আছে, যেমন দরকার আছে বুলেট ভাইয়ের মতো পাগলাটে বন্ধু বা বড় ভাইয়ের।
দুটো ভূতের এবং ভীতির গল্প আছে। ‘গল্পের খাতা’ এবং ‘রাজসঙ্গী’। নিজে ভূত-টুতে খুব ভয় পাই না বলে এসব গল্প নিশ্চিন্তে লিখে চলি। পরে দেখি, অনেকে ভয় পেয়েছে। অতিপ্রাকৃত গল্পের সার্থকতাই নাকি ভীতিসঞ্চার। অতএব...
প্রেমের গল্প না থাকলে সংকলন নাকি সম্পূর্ণ হয় না। আছে, ‘গয়না’। গয়না বহুমুখী একটা জিনিস। বর্তমানের ভালোবাসা। আবার ভবিষ্যতের ভরসা। আবেগ, সঙ্গে সম্পদও। এর অর্থমূল্যের চাপে কখনও কখনও ভালোবাসা হারিয়ে যায়। আসলে হারিয়ে যায় বলে মনে হয়। কিন্তু হারায় না। একমত? জানি সবাই মানবে না। প্রেমের ক্ষেত্রে হাজার তত্ত্ব। শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এক হাজার একতম তত্ত্ব বেরোবে। বেরোতেই থাকবে...
সবশেষে ‘মেয়ের বাবা’। দেখতে পাই, মেয়ে না থেকেও কী এক ম্যাজিকে সুজন নামের এক মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মেয়ের বাবা হয়ে ওঠে।
যোগ-বিয়োগে এই হচ্ছে দশের গল্প। সেসব গল্পের পেছনে কত গল্প। তবে আমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় গল্প হলো, আমি গল্পই বলতে চাই শুধু। জীবনে, চরিত্রে, ঘটনায়-দুর্ঘটনায় গল্পই খুঁজে চলি। গল্পের সন্ধান আর গল্প শোনানোর চেয়ে বড় আনন্দ পৃথিবীতে নেই বড় একটা।
মোস্তফা মামুন ।। কথাসাহিত্যিক