রোহান চৌধুরী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে তার বাড়ি। তবে বড় হয়েছেন ওমানের মাস্কাট শহরে। প্রায় বছর পাঁচেক আগে রোহান ইউক্রেনের খারকিভ ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন অ্যান্ড বায়োমেডিকেল সাইন্সে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি পঞ্চম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। ছেলের সঙ্গে দেখা করতে মাস্কাট থেকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এসে অবস্থান করছেন রোহানের বাবা-মা। রোববার (গতকাল) তাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি ওলট-পালট করে দিয়েছে।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে আলাপ হয় রোহানের। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই মাস্কাটে। বড় হয়েছি সেখানে। তবে প্রতি বছর বাবা-মায়ের সঙ্গে আমাদের দেশের বাড়ি চট্টগ্রামে যেতাম। আমি মেডিকেলে পড়াশোনা করছি ইউক্রেনের খারকিভ ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন অ্যান্ড বায়োমেডিকেল সাইন্সে। আমার পড়াশোনা শেষ হতে আরও দেড় বছর লাগবে। গত তিন সপ্তাহ আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেশে যাওয়ার কথা ছিল। গতকাল আমার দেশে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যে এমন হবে সেটা তো জানতাম না। এমন হলে আরও আগেই দেশে চলে যেতাম।’

বা-মায়ের কোলে ফিরতে চান জানিয়ে রোহান বলেন, ‘দেশে বাবা-মা অস্থির হয়ে আছেন। আমিও মা-বাবার জন্য সিরিয়াস হয়ে আছি। আমি দেশে ফিরতে চাই। আমার মতো অন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, যারা ইউক্রেনে আটকা পড়েছেন তারাও যেন বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে পারেন সেই প্রার্থনা করছি। আমরা দেশে ফিরতে সরকারের সহযোগিতা চাই।’

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে চাওয়ার পর থেকে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি এ উত্তেজনা চূড়ায় পৌঁছায়। এর জেরে অবশেষে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া।

গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের নির্দেশে জল, স্থল ও আকাশপথে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রুশ সৈন্যরা। হামলা শুরুর পর থেকে বাংলাদেশিরা দেশটি ছাড়তে মরিয়া হয়ে ওঠেন। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। কারণ সেখানে বিমান চলাচল বন্ধ। স্থলপথে যানবাহন চলাচলও স্বাভাবিক নয়। আবার অনেকে বাসা থেকে পরিবার নিয়ে বের হতেও সাহস পাচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের সীমান্তে যে যাবেন, সেই অর্থও নেই অনেকের কাছে।

ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দেশটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন বিদেশিসহ সেখানকার নাগরিকরাও। সেখানকার বিভিন্ন শহরে অবস্থান করা বাংলাদেশিরাও ছুটছেন পোল্যান্ড, রোমানিয়া বা হাঙ্গেরি সীমান্তের দিকে। ইতোমধ্যে চার শতাধিক বাংলাদেশি দেশটি ছেড়ে অন্য দেশে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন।

এমন পরিস্থিতি তিনি বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন কি না? রোহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমিও চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। আমি কতদূর পর্যন্ত যেতে পারব, সেটা নিয়ে শঙ্কায় আছি। বিমান বন্ধ, বাস পাওয়া যাচ্ছে না, ট্রেন বা টেক্সিও মিলছে না। যারা বের হয়েছেন তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। যেকোনো সময় বোমিং হতে পারে। আমরা যেসব ভিডিও দেখছি প্রতিদিন, সেগুলো দেখে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছি না এখন। আমরা এখানে কি পরিস্থিতির মধ্যে আছি সেটা তো কেউ দেখছে না। সেনারা মানুষের সঙ্গে যা ইচ্ছে, তাই করছে।’

রাতে ঘুমাতে পারেন না জানিয়ে রোহান বলেন, ‘আমাদের কীভাবে দিন কাটছে, সেটা আপনাদের বোঝাতে পারব না। সবকিছু বন্ধ। খাবার নিয়ে সমস্যা। রাতে ঘুমতে যাই ঠিকই, কিন্তু ঘুম আসে না। এখানে বোমিং হচ্ছে।’

পোল্যান্ড, রোমানিয়া বা হাঙ্গেরি সীমান্তের কাছাকাছি শহরগুলোতে (পূর্ব ইউক্রেন) আটকে পড়া বাংলাদেশিরা সহজে বের হতে পারলেও পশ্চিম ইউক্রেন থেকে এসব বর্ডারের দূরত্ব হাজার কিলোমিটারের বেশি হওয়ায় বিপাকে পড়েছে সেসব শহরে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা। এক্ষেত্রে পশ্চিম ইউক্রেনে আটকা পড়াদের ক্ষেত্রে রাশিয়ায় প্রবেশে সমাধান দেখছেন রোহান।

তিনি বলেন, ‘পূর্ব ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ড, রোমানিয়া বা হাঙ্গেরি বর্ডার কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে মনোযোগটা বেশি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা পশ্চিম ইউক্রেনে তাদের পক্ষে অতদূর যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমরা চাই আমাদের সরকার সাহায্য করুক। আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী সীমান্ত রাশিয়া। যদি আমরা রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারি, সেখানে যেতে পারি; তাহলে সেখান থেকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে আমরা আমাদের ঘরে যেতে পারব।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, পোল্যান্ড দূতাবাসের মাধ্যমে ইউক্রেনে আটকে পড়াদের নিরাপদে ও দেশে ফেরানোর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিরা দেশটিতে আশ্রয় নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে আশ্রয় নিয়েছে ৪০০ জন বাংলাদেশি, এদের মধ্যে ৪৬ জন ওয়ারশতে বাংলাদেশ দূতাবাসের ব্যবস্থায় অস্থায়ী আশ্রয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে হাঙ্গেরিতে ১৫ জন এবং রোমানিয়ায় তিন জন বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছেন। দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে এসব বাংলাদেশির দেশে প্রত্যাবর্তনের কাজ চলছে।

ইউক্রেনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। পোল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস সেখানকার যোগাযোগ রক্ষা করে। ইউক্রেনে ঠিক কত বাংলাদেশির অবস্থান বা বসবাস তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই সরকারের কাছে। তবে ওয়ারশর বাংলাদেশ দূতাবাসের ধারণা, দেড় হাজারের মতো বাংলাদেশি দেশটিতে অবস্থান করছেন।

এনআই/এসএসএইচ