যে অপহরণ হার মানাল নাটক-সিনেমার গল্পকে
নাটকীয় কায়দায় আইনজীবীকে অপহরণ করা সেই মডেলকন্যা ও সহযোগী/ ছবি: সংগৃহীত
এটি কোনো সিনেমার গল্প কিংবা রূপকথার কল্পকাহিনী নয়। তবে বাস্তবে যা ‘মঞ্চস্থ’ হয়েছে তা এক মডেলকন্যার অভিনব অপহরণের নির্মমতার গল্প। সঙ্গে সিদ্ধহস্ত কয়েকজন ‘অভিনেতা’। অর্থের লোভে তাদের সাজানো অপহরণের গল্প এবং এর বাস্তবায়ন নির্মিত নাটক-সিনেমাকেও হার মানায়। যেখানে জড়িত স্বয়ং হবু স্ত্রীও।
ভারতীয় টিভি সিরিজ ক্রাইম পেট্রোল দেখেই পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার নেপথ্যে মডেলকন্যা সুরাইয়া নীল (২০)। গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সাতক্ষীরা থেকে খুলনা পাইওনিয়র কলেজের সামনে বাগদত্তা রাবেয়া সুলতানা রিতুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফা ওরফে মলিন (৩৩)।
বিজ্ঞাপন
এরপর ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয় পরিবারের কাছে। ১০ হাজার টাকা তাৎক্ষণিক বিকাশে দেওয়া হলেও মুক্তিপণের ৩০ লাখ টাকা আদায়ের কৌশল হিসেবে পিতা ও দুলাভাইকে ফোন করে মারধর এবং কান্নার আওয়াজও শোনানো হয়।
শেষমেশ অভিযোগ পাওয়ার পর ওই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একটি দল। অপহৃত ভিকটিম আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফাকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও অপহরণে জড়িত হবু স্ত্রী রয়েছেন পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ‘গত ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফা ওরফে মলিন সাতক্ষীরা নিজ বাড়ি হয়ে খুলনা পাইওনিয়র কলেজের সামনে তার বাগদত্তা রাবেয়া সুলতানা রিতুর সঙ্গে দেখা করে এবং তারা একত্রে ঘুরতে যান। এমন ঘটনা মোটেও বিচিত্র নয়।’
কিন্তু তিনি ঘুণাক্ষরেও এমনটি ভাবেননি যে, হবু স্ত্রী তাকে অপহরণ করতে যাচ্ছেন নিছক অর্থের লোভে। তিনি না ভাবলেও এমনটিই ঘটে গেল তার জীবনে। ঘটনার বিবরণ সিনেমা বা নাটকের গল্পকেও যেন হারা মানায়।
পিবিআই প্রধান ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘হবু স্ত্রী রাবেয়া সুলতানার বান্ধবী মডেলকন্যা সুরাইয়া নীল পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আইনজীবী মলিনকে ফোনে বলেন, শ্যালিকার বাসায় এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। তিনি অপরিচিত কারও বাসায় যাবেন না সাফ জানিয়ে দেন। কোনোভাবে তাকে রাজি করতে না পেরে রাবেয়ার সঙ্গে আসেন মডেলকন্যা সুরাইয়া।’
‘তাদের সঙ্গে ভুক্তভোগী আইনজীবী মলিন মডেল কন্যার বাসায় যান। তাদের কথা বলার এক পর্যায়ে নাটকীয় কায়দায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই আইনজীবীর হাত-পা বেঁধে ফেলেন সুরাইয়া নীল, তার স্বামী হাবিব মলিন ওরফে রাজ (২৪) এবং রাজের বন্ধু আব্দুস সালাম (২৪)। পরবর্তীতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আবু হেনা মোস্তফা মলিন তার বন্ধু হাফিজকে ফোন করেন, সে খুব বিপদে আছে এবং তার টাকা প্রয়োজন বললে হাফিজ তাকে বিকাশের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা পাঠান।’
‘পরে নিজেদের পরিচয় গোপন করে আবু হেনা মোস্তফার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দিয়ে পর্যায়ক্রমে তার পিতা এবং দুলাভাইকে ফোন করে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তাকে মারধর করে কান্নার আওয়াজও শোনানো হয়। মুক্তিপণ না দিলে তারা আবু হেনা মোস্তফা কে হত্যা করবে বলে জানায়।’
অভিযোগ পাওয়ার পর পিবিআই যশোর জেলা ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার (এসপি) রেশমা শারমিনের নেতৃত্বে একটি দল মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ফাঁদ পাতেন। কথামতো মুক্তিপণের টাকা নিতে যাওয়া শাহীন শিকদার (১৮) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে। তাকে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করে আব্দুস সালাম (২৪) ও কথিত মডেলকন্যা সুরাইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় অপহৃত আইনজীবীকে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বনজ কুমার বলেন, ‘ভিকটিম আবু হেনা মোস্তফা পেশায় একজন আইনজীবী। তার সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানাধীন প্রতাবনগর গ্রামের এস এম হারুনর রশিদের কন্যা রাবেয়া সুলতানা রিতুর সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়। অভিযুক্ত সুরাইয়া রিতু রাবেয়ার বান্ধবী।’
গত ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলা আবু হেনা মোস্তফা রাবেয়া সুলতানা রিতুর সঙ্গে খুলনা পাইওনিয়র কলেজের সামনে দেখা করে এবং তারা একত্রে জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পার্কে ঘুরতে যান। সেখানে তাদের অভিযুক্ত সুরাইয়ার সঙ্গে দেখা হয়।
সুরাইয়া ভিকটিম আবু হেনা মোস্তফাকে কৌশলে যশোর জেলার অভয়নগর থানাধীন একতাপুর সাকি এলাকার রাবেয়া খাতুনের বাড়িতে নিয়ে যান। এক মাস পূর্বে ওই বাড়িতে অভিযুক্ত সুরাইয়া ও আব্দুস সালাম স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ভাড়াটিয়া হিসেবে ওঠেন।
পিবিআই প্রধান বলেন, ‘কোথাও অপরাধের সংবাদ পাওয়া মাত্র আমরা দলীয়ভাবে কাজ শুরু করি। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকি। সেটারই সফলতা হচ্ছে অপহৃত ভিকটিম জীবিত উদ্ধার ও চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার।’
তিনি বলেন, ‘এখনও পলাতক সেই হবু স্ত্রী রাবেয়া সুলতানা, সুরাইয়ার স্বামী হাবিব মলিন ওরফে রাজ, তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। পাশাপাশি গ্রেপ্তারদের যশোর আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। সেখানে ভিকটিম আইনজীবী উপস্থিত রয়েছেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী মাঝিও উপস্থিত রয়েছেন। গ্রেপ্তার আসামিরাসহ সবার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার কথা রয়েছে।’
জেইউ/এফআর