মুক্তিযুদ্ধে কূটনীতিকদের অবদান ‘স্বর্ণাক্ষরে’ লিখতে চান মোমেন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করে যেসব কূটনীতিক মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন তাদের প্রত্যেকের নাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বর্ণাক্ষরে খোদিত করে রাখা হবে।
সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ফরেন সার্ভিস ডে উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
বিজ্ঞাপন
ড. মোমেন বর্তমানে সিঙ্গাপুর সফরে রয়েছেন। সিঙ্গাপুর থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। মোমেন বলেন, আমি প্রস্তাব করছি, যে সকল কূটনীতিক ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তাদের জন্য বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে একটি মনোরম স্মরণীয় প্লেক তৈরি করে প্রত্যেকের নাম আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বর্ণাক্ষরে খোদিত করে রাখা একান্ত প্রয়োজন। এ কাজটি আমরা খুব শিগগিরই করব।
স্বাধীনতার ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশি কূটনীতিকদের অবদান স্মরণীয় করে রাখতে ২০১২ সাল থেকে ১৮ এপ্রিল ফরেন সার্ভিস দিবস পালন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
১৯৭১ সালের এই দিনে কলকাতায় নিযুক্ত ডেপুটি হাইকমিশনার এম. হুসেন আলী ও তৃতীয় সচিব আনোয়ারুল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ও কলকাতায় তৎকালীন পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনকে বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন হিসেবে ঘোষণা করেন।
দিনটি স্মরণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তৎকালীন পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন কলকাতাতে বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং এটিকে বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন, কলকাতা হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঐতিহাসিক দিনে কলকাতা ডেপুটি হাই কমিশনেই প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, যেটা ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশের মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন।
তিনি বলেন, কলকাতায় এ দিনে বিদ্রোহ ঘোষণা করা কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও ছিলেন সহকারী প্রেস এটাশে মাকসুদ আলী এবং প্রথম সচিব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। তারও আগে ৬ এপ্রিল তারিখে নয়াদিল্লীতে অবস্থিত পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত তৃতীয় সচিব কাজী নজরুল ইসলাম ও সহকারী প্রেস এটাশে মাকসুদ আলী পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করেন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এইচ মাহমুদ আলী সে সময় নিউইয়র্কে অবস্থিত পাকিস্তানের কনস্যুলেট জেনারেলে কর্মরত ছিলেন। তিনি ২৫ এপ্রিল পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদ্রোহ করার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, আমাদের যুদ্ধ কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। যুদ্ধ সে সময়ে হয়েছে, এখনও চলছে। এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরে যখন আমি দেশে আসি সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেশে এসে দেখি এ এক নতুন বাংলাদেশ। ১৯৭৫ এর পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ১৯৮০ সালে ব্যক্তিগতভাবে চাঁদা তুলে পহেলা বৈশাখ পালন করতে গিয়েও সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমি নতুনদের উদ্দেশ্যে বলব, আমাদের যুদ্ধ এখনও চলমান রয়েছে।
১৯৭১ সালের ৬ জুন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও ১ আগস্টে ওয়াশিংটন ডিসিতে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ২২ জন কূটনীতিক একযোগে পদত্যাগ করেন এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে কূটনীতিকদের অবদান কিভাবে মুজিবনগর সরকারকে সহযোগিতা করেছিল সেই প্রেক্ষাপট টেনে ড. মোমেন বলেন, তাদের আত্মত্যাগের কারণে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ও পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে, যার ফলে হানাদার বাহিনী ক্রমান্বয়ে সারা বিশ্বে এক ঘরে হয়ে পড়ে। দেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধের সমান্তরালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি কূটনীতিকদের দ্বারা পরিচালিত এ যুদ্ধের কারণে আমাদের বিজয় অর্জন তরান্বিত হয়।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তরুণ বাঙালি কর্মকর্তাদের প্রলোভন দেখিয়েও পাকিস্তানের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এমন এক পরিস্থিতিতে তারা কিভাবে দৃঢ় ছিলেন সেটাই আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তবে এটাও ঠিক যে, কিছু কূটনীতিক এখনকার হয়েও পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন নেন।
লন্ডনে দূতাবাসের প্রথম যে কূটনীতিক মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন তিনি দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ। সাবেক এ কূটনীতিক সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীনতাটা ছিল এক জনযুদ্ধ। ওই সময়ে আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি ছিল দেশ। ইরাক, আর্জেন্টিনা ও ফিলিপিন্সে ওই সময় রাষ্ট্রদূতরা বাঙালি ছিলেন। তারাও পক্ষত্যাগ করেছিলেন। এভাবে বিভিন্ন দেশে যখন কূটনীতিকরা পক্ষত্যাগ করেছিলেন, সারাবিশ্বে কিন্তু একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
অনুষ্ঠানে সাবেক কূটনীতিক ওয়ালিয়ার রহমান সে সময় পাকিস্তান ত্যাগ করে যারা মুজিবনগর সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন বা যেসব কূটনীতিক দেশের জন্য চাকরি ছেড়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের তালিকা করার আহ্বান জানান।
এনআই/আইএসএইচ