সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে ১০ দফা দাবি মহিলা পরিষদের
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও উসকানিমূলক ঘটনায় দায়ী প্রকৃত অপরাধী ও ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার ও যথাযথ আইনের আওতায় আনাসহ দশ দফা দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
সোমবার দুপুরে সেগুনবাগিচায় সুফিয়া কামাল ভবন মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি উত্থাপন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি রেখা চৌধুরী।
বিজ্ঞাপন
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা সবাই বাঙালি- এই চেতনার আলোকেই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসীসহ সকল নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সংবিধানে সকল মানুষের সমঅধিকারের কথা বলা হলেও গত কয়েক দশক ধরেই সাম্প্রদায়িক হামলা ও বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতার ঘটনা আমাদের সমাজে ঘটেই চলেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ম্লান করে দিচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
দেশে সাম্প্রদায়িক ইস্যু নিয়ে সংঘটিত বেশ কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, এ ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও প্রতিটি ঘটনা সাম্প্রদায়িকতার সুতোয় বাধা। একশ্রেণীর উগ্র-মৌলবাদ গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে এবং অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আসছে। অথচ প্রকৃত অপরাধীদের স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে না, শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে না, বরং নাগরিক সমাজ, মানবাধিকারকর্মী এবং ভিন্ন মতবাদের মানুষ ও মুক্তচিন্তার মানুষের জন্য যে ধরণের পরিসর থাকা প্রয়োজন তা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় প্রদানের ফলে নারীর প্রগতি, সমঅধিকার, নারীর প্রতি সহিংস আচরণ বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে আরও জটিল হয়ে উঠছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
নারীর মানবাধিকার পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক। এ পরিস্থিতির উত্তরণে সংগঠনের পক্ষে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়।
দাবিসমূহ
১. যেকোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও উসকানিমূলক ঘটনার প্রকৃত অপরাধী ও ইন্ধনদাতাদের নিরপেক্ষভাবে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার ও যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
২. সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে।
৩. সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাসমূহ ঘটানো হচ্ছে, সে বিষয়ে যথাযথ তদন্তপুর্বক অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ ও যথাযথ প্রয়োগ করা।
৬. রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭. ধর্মীয় সমাবেশ বা ওয়াজ মাহফিল থেকে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ এবং নারীর বিরুদ্ধে সব প্রকার অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই ধরনের অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে।
৮. ৭২’ এর সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৯. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে হলে আজ সরকারি দলসহ সকল রাজনৈতিক দলকে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
১০. সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয় রেখে মাদরাসা শিক্ষার কারিকুলাম যুগোপযোগী করতে হবে। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে মডারেটরের বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক, নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ, যুক্তিবাদী সমাজ দেখতে চায় মহিলা পরিষদ। সমাজে সবার অধিকার বাস্তবায়ন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকে। কিন্তু বাস্তবে বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক সূচকে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ বেড়েছে। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে উন্নয়নের ছোঁয়া নিজের জীবনে কোথায় তা সবার জন্য ভাবার সময় এসেছে।
উগ্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নানা কূটকৌশল অবলম্বন করে উন্নয়নের ক্ষেত্রকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নাগরিক সমাজ ও নারী আন্দোলনের ভূমিকা নির্ধারণের সময় হয়ে গেছে। ক্ষমতাশালীরা একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা সুবিধা নিচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে, বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়েছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তিনি এসময় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্র পরিচালক, গণমাধ্যমকর্মী, নাগরিক সমাজকে সোচ্চার হতে আহ্বান জানান।
জেইউ/আরএইচ