পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার নন্দন কুমার দত্ত রোড। ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত একটি রাস্তা। ছোট অলিগলি দিয়ে রিকশা ও মোটরযানে সবই চলছে যার যার নিজস্ব গতিতে। দোকানপাটে হই-হুল্লোড়ে মানুষের যাতায়াত থেকে শুরু করে কোনো কিছুরই কমতি নেই। দেখে বোঝার উপায় নেই, মাত্র দুই বছর আগে এ গলির ওয়াহিদ ম্যানশনে ঘটেছে দেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এই অগ্নি দুর্ঘটনায় নারী-শিশুসহ ঝরে গেছে ৭১টি প্রাণ। চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির ভয়াবহ স্মৃতি ওয়াহিদ ম্যানশন বা নন্দন কুমার দত্ত রোডে না থাকলেও নিহতদের স্বজনদের মনে এখনও রয়ে গেছে সেই ক্ষত।

ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হলেও স্বজনদের মনে একটি প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে কী এমন ছিল ওয়াহিদ ম্যানশনে? মানুষগুলো পুড়ে এমন কয়লা হয়ে গেছে। এ ঘটনায় করা মামলার অগ্রগতি ও পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে স্বজনদের মনে। তারা প্রশ্ন রাখছেন দুই বছর পার হয়ে গেলেও পুলিশ কেন এখনও এ মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারেনি। পুরান ঢাকাকে এত বড় ট্র্যাজেডি পরও কেন রাসায়নিক গুদাম মুক্ত করা যায়নি।

শুক্রবার (২০ ফেব্রুয়ারি) চুড়িহাট্টার নন্দন কুমার দত্ত রোড সরেজমিনে ঘুরে ও আগত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঘটনার দুই বছর পর স্বজনরা যা বলছেন
দুই বছর আগে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে স্বামী ফয়সালকে হারান পুরান ঢাকার হাজী বালু রোডের বাসিন্দা ফাতেমা আক্তার। স্বামীকে হারিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে কষ্টে সংসার কাটছে তার।

ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে ফাতেমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঘটনার দিন আমার স্বামী শাশুড়ির ওষুধ আনতে চুড়িহাট্টায় গিয়েছিলেন। চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার দৃশ্য আমার বড় মেয়ে টিভিতে দেখে বলে, মা আব্বু না চুড়িহাট্টা গিয়েছিল সেখানে তো আগুন লেগেছে। আব্বুকে ফোন দিয়ে দেখতো আব্বু কোথায় আছে। তখন দুইটা ফোন নাম্বারে ফোন করে আমরা না পেয়ে ঘটনাস্থলে আসি। তখন ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বললে তারা আমাদের বলে, আপনারা ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে খোঁজ নিন। পরে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার স্বামীর বন্ধু আগুনে পুড়ে আহত অবস্থায় বারান্দায় বসে রয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার বন্ধু কোথায় তখন সে বলে ভাবি সে তো মারা গেছে। আমি তখন তাকে বলি আপনার কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? তখন ভেবেছিলাম হয়তো আগুনে পুড়ে আহত হয়ে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, সেজন্যে উল্টাপাল্টা কথা বলছে। এরপর টানা দুই-তিন দিন আমার স্বামীকে নানা হাসপাতালে খুঁজি কিন্তু তাকে পাইনি। পরে ডিএনএ টেস্টের জন্য আমার দুই মেয়ের নমুনা নেয় সিআইডি। ডিএনএ পরীক্ষার পর ১২ মার্চ আমাকে ফোন দিয়ে বলে আমার স্বামীর মরদেহ পাওয়া গেছে।’

আমার স্বামীর মরদেহ দেখে বুঝতে পারি নাই এটা কি। আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। এটা কি দেখলাম। এটা কি আমার স্বামী নাকি অন্য কিছু। আমি কোনো লাশ দেখি নাই। শুধু কয়লা আর কয়লা। এখানে কি এমন ছিল যে মানুষগুলো এত পুড়ে গেছে? গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে তো এভাবে মানুষ পোড়ার কথা না।

ফাতেমা আক্তার, পুরান ঢাকার হাজী বালু রোডের বাসিন্দা, চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে নিহত ফয়সালের স্ত্রী

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীর মরদেহ দেখে বুঝতে পারি নাই এটা কি। আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। এটা কি দেখলাম। এটা কি আমার স্বামী নাকি অন্য কিছু। আমি কোনো লাশ দেখি নাই। শুধু কয়লা আর কয়লা। এখানে কি এমন ছিল যে মানুষগুলো এত পুড়ে গেছে? গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে তো এভাবে মানুষ পোড়ার কথা না। নিশ্চয়ই এমন কোনো দার্হ্যপদার্থ ছিল, যার ফলে মানুষ পুড়ে এমন কয়লা হয়ে গেছে। মরদেহ দেখে বুঝাই যায়নি এটা মানুষের। হাড়গুলো পর্যন্ত কয়লা হয়ে গেছে।’

এ সময় তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা আর পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম চাই না। আর কোনো মেয়ে যেন আমার মতো স্বামী না হারায়। আর সন্তানরা যেন বাবা না হারায়। আর কোন মায়ের বুক যেন খালি না হয়। এখনও এখানে কেমিক্যালের গুদাম আছে। রাতের বেলায় সব কেমিক্যাল লুকিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া হয়।’

দুই বছর আগের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশন/ ছবি: ঢাকা পোস্ট

এদিকে দুই বছরেও মামলার কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নিহতের স্বজনেরা। তারা বলছেন, কোনো অদৃশ্য কারণে মামলার অগ্রগতি হচ্ছে না। না হলে পুলিশ দুই বছরেও কেন মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দিতে পারেনি।

মো. নাসির উদ্দিনের (৬২) একমাত্র ছেলে মাহির উদ্দিন (২২) এ অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলে মারা যায়। তিনি মামলার অগ্রগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঘটনার পর ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিককে পুলিশ আটক করলেও তাদের রিমান্ডে নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করে ছেড়ে দিয়েছে। তাদের নিয়ে যদি ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো তাহলে বের হয়ে আসতো আসল অপরাধীকে এবং এ কেমিক্যাল গোডাউনের মালিককে ছিলেন।’ 

মামলা হলো কিন্তু বিল্ডিং মালিকরা এক মাস জেলে থাকে নাই, জামিনে বের হয়ে গেছে। এতগুলো মানুষ মারা গেল তারা কিভাবে এত দ্রুত বের হয়ে যায়।

মো. নাসির উদ্দিন, চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে নিহত মাহির উদ্দিনের বাবা

নাসির উদ্দিন আরও বলেন, ‘আজ পর্যন্ত কেমিক্যাল গোডাউনের মালিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এর পেছনে কি কারণ আছে আমরা তা জানি না। মামলা হলো কিন্তু বিল্ডিং মালিকরা এক মাস জেলে থাকে নাই, জামিনে বের হয়ে গেছে। এতগুলো মানুষ মারা গেল তারা কিভাবে এত দ্রুত বের হয়ে যায়। ওদের তো কেউ মারা যায়নি। ওরা তো কখনো বুঝবে না স্বজন হারানোর কষ্ট। আবার তারা পুড়ে যাওয়া বিল্ডিংয়ের কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করে দিয়েছে। আবার এই বিল্ডিং দাঁড়িয়ে গেছে।’

এ সময় তিনি পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামের বিষয়ে বলেন, রাসায়নিক গুদাম যে জায়গায় রয়েছে সেই জায়গায় আমরা থাকতে চাই না। আমরা লোক দেখানো অভিযান চাই না। আমরা চাই সরকার পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করুক। এমন আর একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার মতো পর্যাপ্ত কেমিক্যাল পুরান ঢাকায় রয়েছে। যেমন বন জঙ্গলে একসঙ্গে হরিণ ও বাঘ থাকতে পারে না, তেমনি পুরান ঢাকার এ ঘনবসতি এলাকায় মানুষ আর কেমিক্যাল একসঙ্গে থাকতে পারে না।

ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে বিধ্বস্ত চুড়িহাট্টা/ ফাইল ছবি

চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি মামলার অগ্রগতি
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির দুই বছর পার হয়ে গেলেও মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিতে পারেনি পুলিশ। আর এ ঘটনায় কারা প্রকৃত দোষী তাও এখন পর্যন্ত পুলিশের তদন্তে উঠে আসেনি। গত দুই বছরে পুলিশ মামলার দুই জন সন্দেহভাজন আসামিকে যেমন গ্রেপ্তার করতে পারেনি, তেমনি তাদের নাম ঠিকানাও খুঁজে পায়নি পুলিশ। এছাড়া ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে সোহেল ওরফে শহীদ ও মো. হাসানকে গ্রেপ্তার করলেও পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় তারা জামিনে বের হয়ে গেছেন।

যদিও নিহত ৭১ জনের মধ্যে ৬৭ জনের ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ প্রতিবেদন পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ। ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার পরেও কেন পুলিশ অভিযোগপত্র দিতে দেরি করছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।

পুলিশ যা বলছে

মামলার অগ্রগতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ প্রতিবেদন পেতে অনেক সময় লেগেছে। তাই অভিযোগপত্র দিতে আমাদের দেরি হয়েছে।

মওদুদ হাওলাদার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), চকবাজার থানা

এ বিষয়ে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার বলেন, মামলার অগ্রগতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ প্রতিবেদন পেতে অনেক সময় লেগেছে। তাই অভিযোগপত্র দিতে আমাদের দেরি হয়েছে। এ মামলায় শুরুতে আমরা দুই জনকে গ্রেপ্তার করেছিলাম তারা এখন জামিনে আছে। এছাড়া সন্দেহভাজন দুই জন আসামিকে খোঁজা হচ্ছে। তবে আমরা আর দেরি করব না, দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র দিয়ে দিব।

তবে মামলার অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট নন মামলার বাদী মো. আসিফ আহম্মেদ। তিনি বলেন, গত দুই বছরে পুলিশ বের করতে পারেনি এ ঘটনার প্রকৃত দোষীকে। তাহলে কি তদন্ত করল পুলিশ গত দুই বছর ধরে। আর কয় বছর লাগবে অভিযোগপত্র দিতে কে জানে।

এখনো পুরান ঢাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের গোডাউন
চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকা রাসায়নিক দ্রব্যের গোডাউন সরাতে টানা ১৫ দিন অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানের সময় গোডাউনের সংখ্যা কিছুটা কমে গেলেও এখন আবার সেই আগের মতোই হয়ে গেছে। তবে আগের মতো খোলামেলাভাবে না থাকলেও লোক চক্ষুর আড়ালে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাসায়নিক গোডাউন গড়ে উঠছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চালানো অভিযানে উঠে আসে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কথা। তারা কোটি কোটি টাকা প্রশাসনকে দিয়ে এ অবৈধ ব্যবসা চালু রেখেছে। আর এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কেউই তেমন মুখ খোলেন না।

বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে জানা যায়, পুরান ঢাকায় মাত্র প্রায় ১ হাজারের মতো রাসায়নিক গোডাউনের লাইসেন্স আছে। কিন্তু ওই এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্যের গোডাউন আছে প্রায় ২০ হাজারের মতো।

সে দিন চুড়িহাট্টা যা ঘটেছিল
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে লাইটারের গ্যাস, সুগন্ধিসহ বিভিন্ন কেমিক্যালের টিউবের বিস্ফোরণে ওয়াহিদ ম্যানশনসহ আশপাশের পাঁচটি ভবন পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ৭১ জন মারা যান। আর আহত হন শতাধিক। ঘটনার পর দিন ২১ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ৩২/৩৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মো. আসিফ চকবাজার থানায় মামলা করেন।

এমএসি/এসএসএইচ