গাজীপুরের কালীগঞ্জ এলাকায় প্রসব বেদনা নিয়ে ‘জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে’ ভর্তি করা হয় এক গর্ভবতী নারীকে। সিজারিয়ানের মাধ্যমে তিনি সন্তান জন্ম দেন। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় শিরিন বেগম (৩২) নামে ওই নারীর।

তার রক্তের গ্রুপ ‘এবি পজিটিভ’ হওয়ায় স্বজনদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এর মধ্যে তার শরীরে ‘বি পজিটিভ’ রক্ত পুশ করা হয়। যার ফলে শিরিন বেগমের খিচুনি ওঠে। ওই হাসপাতালে তার চিকিৎসা করতে থাকে ওটি বয় ও নার্সরা। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যান তিনি।

এ ঘটনায় মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) রাতে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গ্রেপ্তাররা হলেন— হাসপাতালের পরিচালক বন্যা আক্তার (৩১), আশিকুর রহমান (২৫), সংগীতা তেরেজা কস্তা (৩৩), মেরী গমেজ (৪০), সীমা আক্তার (৩৪) ও শামীমা আক্তার (৩২)। এসময় ভিকটিমের চিকিৎসা সংক্রান্ত ও হাসপাতাল পরিচালনার মেয়াদোত্তীর্ণ নথিপত্র উদ্ধার করা হয়।

বুধবার (২৪ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

আরও পড়ুন: ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু : হাসপাতালের পরিচালকসহ গ্রেপ্তার ৬

তিনি বলেন, গত ২১ আগস্ট সকালে গাজীপুরের কালীগঞ্জের বাসিন্দা ভিকটিম শিরিন বেগমের (৩২) প্রসব বেদনা উঠলে পূর্ব পরিচিত ‘জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্যা আক্তারের মাধ্যমে ওই হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ভর্তি করানো হয়। পরে ওটি বয় আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করে সিজারের জন্য রোগীকে ওটিতে নেওয়া হয়। ডাক্তার মাসুদ গাইনোকলজিস্ট না হয়েও রোগীর সিজার করেন।

ওটি শেষে প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে মাসুদের পরামর্শে আশিক এবং বন্যা রোগীর পরিবারকে ‘এবি পজিটিভ’ রক্ত সংগ্রহের কথা বলেন। প্রথমে ভিকটিমের ভাই ও ননদের ছেলের একই গ্রুপের রক্ত হওয়ায় তাদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়।

প্রথমে ভিকটিমের ভাইয়ের শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে রোগীর শরীরে পুশ করা হয়। আরও এক ব্যাগ রক্ত নিতে ননদের ছেলেকে বেডে শোয়ানো হয়। এরই মধ্যেই হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সরা ভিকটিমের শরীরে ‘বি পজিটিভ’ গ্রুপের রক্ত পুশ করেন।

ভিকটিমের ‘এবি পজিটিভ’ গ্রুপের রক্তের পরিবর্তে ‘বি পজিটিভ’ রক্ত পুশ করায় রোগীর খিচুনি উঠলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে আশিকের তত্ত্বাবধানে রোগীর চিকিৎসা চলতে থাকে। একপর্যায়ে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সন্ধ্যার দিকে রোগীকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেয়। পরিবার রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করলে অবস্থার আরও অবনতি হয়। পরে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে’ নিয়মিত কোনো ডাক্তার ছিল না। অথচ সেখানে গড়ে প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০টি সিজারিয়ান অপারেশনসহ প্রায় ৫০টির বেশি বিভিন্ন অপারেশন সম্পন্ন করা হতো। মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালটি। ওটির জন্য রোগী ভেদে বিভিন্ন প্যাকেজে ১০-১৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হতো।

গ্রেপ্তার বন্যা আক্তার ওই হাসপাতালের অন্যতম অংশীদার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার কোনো নার্সিং ডিগ্রি নেই। তবে তিনি স্থানীয় একটি হাসপাতালে সাত বছর নার্সিং ও আড়াই বছর ধরে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছিলেন। বর্তমানে হাসপাতালটির মালিক তিন জন বলে জানা যায়।

গ্রেপ্তার আশিক এসএসসি পাস করে ২০১৬ সালে ম্যাটস থেকে তিন বছরের ডিএমএফ কোর্স পাস করে। হাসপাতালে ২০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে ওটি বয় ও ডক্টর সহকারী হিসেবে কাজ করে আসছিলেন তিনি। ঘটনার দিন আশিক ডা. মাসুদের সহকারী হিসেবে ওটিতে উপস্থিত ছিলেন। তবে সেখানে নার্স ও ভিকটিম পরিবার তাকে ডাক্তার হিসেবে জানত। রোগী তদারকি, ডাক্তারদের সঙ্গে সমন্বয় রাখা, বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করা ও ডাক্তারদের পক্ষে কাগজপত্রে ভুয়া স্বাক্ষর করতেন তিনি।

গ্রেপ্তার সংগীতা তেরেজা কস্তা এসএসসি পাস ও ওই হাসপাতালে সিনিয়র নার্স হিসেবে কর্মরত। মেরী গমেজ এসএসসি পাস ও জুনিয়র নার্স, সীমা আক্তার এসএসসি পাশ ও নার্স, শামীমা আক্তার এসএসসি পাস ও হাসপাতালের রিসিপশনিস্ট হিসেবে কর্মরত।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির লাইসেন্সের মেয়াদ ২০২১ সালের ৩০ জুন শেষ হয়। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্সের মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হলেও তারা আর নবায়ন করেনি।

জেইউ/এসএসএইচ