রাজধানীর কড়াইল বস্তি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দ্বন্দ্ব চলছিল ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খান ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান গ্রুপের মধ্যে। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে ১৭ আগস্ট বস্তির মসজিদে ঢুকে যুবলীগ কর্মী আল আমিনকে (৩৪) হত্যা করা হয়।

গত ২২ ও ২৩ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আল আমিন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ। তারা হলেন- মোহাম্মদ আলী, মো. খাজা, মো. আমজাদ হোসেন, মো. হুমায়ুন কবির রাসেল ও মাসুদ আলম।

গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে আল আমিনকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত বড় ছোঁরা, চাপাতি ও ডিস্ক কুড়াল, লোহার রডসহ দেশি অস্ত্র জব্দ করা হয়।

জানা গেছে, কড়াইল বস্তিতে প্রায় ৪০ হাজার অবৈধ ঘর রয়েছে। প্রতিটি ঘর থেকে প্রতি মাসে নানা বিলের নাম করে ৮-১০ হাজার টাকা করে তোলা হয়ে থাকে। বিপুল পরিমাণ এই চাঁদার টাকার জন্য দুটি গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল।

বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিবি প্রধান মোহাম্মাদ হারুন অর রশীদ এসব তথ্য জানান।

হারুন অর রশীদ বলেন,  কড়াইল বস্তিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৭ আগস্ট রাতে বস্তির এরশাদ মাঠ এবং নূরানী মসজিদ এলাকায় নুরু-কবির-আলী গ্যাংয়ের সঙ্গে রিপন-জুয়েল-শুভ গ্যাংয়ের মারামারি হয়। এ ঘটনায় আল আমিন মারা যান। এছাড়া এই সংঘর্ষে উভয়পক্ষের প্রায় ১০ জন গুরুতর আহত হন।

তিনি বলেন, কড়াইল বস্তিতে দুটি গ্রুপ এই চাঁদাবাজি করে থাকে। এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্রায় প্রতিবছর খুনাখুনি হচ্ছে। বস্তিটি মূলত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত। তবে এর শতকরা ৯০ ভাগ পড়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। মফিজুর রহমান এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর।

বস্তির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাতটি ইউনিটে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুইটি গ্রুপের মধ্যে বিবাদ চলে আসছিল। গত ২২ জুলাই সাতটি ইউনিটের কমিটি হয়। সেগুলো হচ্ছে- কড়াইল উত্তর-১, কড়াইল উত্তর-২, কড়াইল বউবাজার-পূর্ব, কড়াইল বউবাজার-পশ্চিম, কড়াইল-মশার বাজার, কড়াইল-গোডাউন বস্তি এবং কড়াইল-স্যাটেলাইট ইউনিট।

এই সাতটি কমিটির বেশিরভাগ পদে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাদের খানের গ্রুপের প্রাধান্য। যার কারণে স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজের গ্রুপের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের অনুসারীদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র একটি ইউনিটের সভাপতি এবং আরেকটি ইউনিটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছে। বাকিরা সব অন্য গ্রুপের।

ডিবি জানায়, নুর আলম নুরু কড়াইল উত্তর-২/দক্ষিণ ইউনিটের সহ-সভাপতি হওয়ায় এই এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে। এদিকে মফিজ গ্রুপের জসীমউদ্দীন রিপনকে সেক্রেটারি পদ না দিয়ে রফিকুল ইসলাম ওরফে রাজুকে সেক্রেটারি করায় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজ গ্রুপের নেতারা চাঁদাবাজির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে নবগঠিত কমিটির নেতারা নতুন করে মাঠ দখলের অংশ হিসেবে  নিয়মিত মহড়া করতে থাকে। গত ১৭ আগস্ট এশার নামাজের আগে কাদের খান গ্রুপের নুরু-আলী-কবির গ্রুপের মহড়ার এক পর্যায়ে তারা রিপন-জুয়েল গ্রুপের আওলাদকে সামনে পেয়ে মারধর করে।

অল্প সময়ের মধ্যে উভয়পক্ষের লোকজন ভারী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। নুরু গ্রুপের আমজাদ এবং ভাইস্তা মাসুদ নূরানী মসজিদে নামাজ পড়াকালীন রিপন-জুয়েল গ্রুপের লোকেরা মসজিদে গিয়ে তাদের প্রথমে জিআই পাইপ ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা করে।

এসময় নুরুর নেতৃত্বে ভাইগ্না আলী, মোহাম্মদ আলী, কবির, আজিজুল, খাজা, আমজাদ গ্যাং আরো হিংস্র হয়ে একাধিক ঘর ও দোকান ভাঙচুর করে। নুরু ও কবির ছোরা এবং চাপাতি নিয়ে আল আমিন এবং নাসিরকে হত্যার উদ্দেশ্যেই কুপিয়ে জখম করে। নাসির এবং আল আমিন দৌড়ে মসজিদে প্রবেশ করলে সেখানেও তাদের ওপর আক্রমণ করে।

গুরুতর আহত আল আমিন এরশাদ মাঠের একটি ফার্মেসির দোকানে ঢুকলে সেখানেও তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটি রিকশায় উঠলে সেন্টু রিকশাওয়ালাকে মারধর করে।

এসময় খাজা এবং আমজাদ এসে আল আমিনকে আবারও মারধর করে এবং হাসপাতালে যেতে বাধা দেয়। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পথে আল আমিন মারা যায়। এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষের নাসির, নুরুসহ প্রায় ১০ জন গুরুতর আহত হয়।

ডিবি প্রধান বলেন, লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক সহিংসতা এবং হত্যার মতো ঘটনা ঘটে আসছে কড়াইল বস্তিতে। ২০১২ সালে কড়াইল বস্তির পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতির সেবা/সংযোগ- এর অর্থ উত্তোলনের ক্যাশিয়ার বশির হত্যাকাণ্ড, ২০১৪ সালে একই কার্যক্রমে নিয়োজিত দুলাল সরদার হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার কারণে তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র রাকিব হোসাইন হত্যাকাণ্ড, ২০১৮ সালে একই ইস্যুতে নিহত হন রাশেদ কাজী নামে একজন পলিটিক্যাল এক্টিভিস্ট কাম চাঁদাবাজ। সর্বশেষ ২০২২ সালে আল আমিন হত্যার ঘটনা ছাড়াও আরো একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং সহিংস ঘটনা ঘটে এই বস্তিতে।

এমএসি