বরগুনায় সহকর্মীদের পরিণতি দেখে ক্ষুব্ধ পুলিশ
‘বড় ধরনের কোনো বিক্ষোভ বা আন্দোলন হলে এখন থেকে এগোবে না কোনো পুলিশ সদস্য। কারণ, পুলিশকে এখন অনেক কিছুই ভেবে-চিন্তে করতে হবে। অন্যথায়, মহরমের মতো (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলী) শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’
বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে পরিচালিত দুটি ফেসবুক গ্রুপে এভাবেই ক্ষোভের কথা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার সমমর্যাদার (এএসপি) এক কর্মকর্তা। গ্রুপ দুটির মধ্যে একটির সদস্য এক লাখ ৩০ হাজার ৫০০ জন এবং আরেকটিতে ৪২ হাজার ৪০০ জন।
বিজ্ঞাপন
গত ১৫ আগস্ট বরগুনার শিল্পকলা একাডেমি ও আইনজীবী সমিতির সামনে ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় আলোচিত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলীকে তাৎক্ষণিক বরগুনা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনিসহ ১৩ পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করে ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এরপরই ক্ষোভ সৃষ্টি হয় পুলিশের মধ্যে।
ওই ঘটনার পর পুলিশের কনস্টেবল পদের আরেক সদস্য ফেসবুকে লেখেন, ‘আইনের ধারা অনুযায়ী সরকারি মালামাল, দেশের সম্পদ ও প্রশাসনের আত্মমর্যাদা রক্ষায় ওই সব পুলিশ সদস্য যথাযথ ভূমিকা রেখেছেন। তারা প্রমাণ দিয়েছেন অন্যায়কারী যে দলেরই হোক, যে মতাদর্শেরই হোক তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অতীতে বরগুনার কিছু কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে দেখা যায়, সেখানকার মানুষ অল্প ও তুচ্ছ বিষয়ে রামদা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশ ওই সদস্যরা যথাযথ ভূমিকা নিয়ে অনেক জীবন রক্ষা করল। অথচ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো। বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
বিজ্ঞাপন
এছাড়া প্রায় হাজারখানেক পুলিশ সদস্য ‘স্যালুট মহরম, স্যালুট পুলিশ’ লিখে পোস্ট ও কমেন্ট দিয়েছেন।
দুই প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ যা বললেন
সেদিন শিল্পকলা ও আইনজীবী সমিতি এলাকায় দায়িত্ব পালন করা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন বিক্ষোভ হচ্ছিল তখন ঘটনাস্থল শিল্পকলা একাডেমিতে ছিলেন স্থানীয় এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, জেলা প্রশাসক (ডিসি), পৌর মেয়র, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব মৃধাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিক্ষুব্ধরা যাতে তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারে এবং ১৫ আগস্টের আলোচনা ভণ্ডুল করতে না পারে, এমনকি বড় ধরনের সংঘর্ষ ও প্রাণহানি এড়ানোর জন্য পুলিশ অ্যাকশনে যায়।
এদিকে, ওই ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম তারেক রহমানও উপস্থিত ছিলেন ঘটনাস্থলে। ছিলেন অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। নিজ বাহিনীর ঊর্ধ্বতনদের নিরাপত্তা দিতে করা লাঠিচার্জের জন্য অধস্তনদের দায়ী করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারাও।
ঘটনাস্থলে ছিলেন কিন্তু অভিযুক্ত হননি এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা বিক্ষোভ ও স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে বরগুনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে ইট-পাটকেল ও লাঠি নিয়ে নবনির্বাচিত ও পদবঞ্চিতদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় রাস্তার পাশে থাকা কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। মোটরসাইকেলে থাকা হেলমেটগুলো নিয়ে শিল্পকলার দিকে ছুড়তে থাকে তারা। পুলিশ প্রথমে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে শুধু পরিস্থিতি দেখছিল। কোনো অ্যাকশনে যায়নি। তবে হঠাৎ পুলিশের ওপর ইট নিক্ষেপ শুরু হয়। ঢাল দিয়ে যখন আত্মরক্ষা করছিলেন পুলিশ সদস্যরা তখন হঠাৎ একটি ইট পুলিশের গাড়িতে আঘাত করে এবং কাঁচ ভেঙে যায়। তখন পুলিশ সদস্যরা নড়েচড়ে বসে। শিল্পকলার ভেতরে তখন অনুষ্ঠান চলছিল। ভেতরে ছিলেন এমপি, ডিসিসহ ভিআইপিরা। যদি বিক্ষুব্ধ দুই পক্ষ (নবনির্বাচিত কমিটি ও পদবঞ্চিতরা) সংঘর্ষে লিপ্ত থাকত তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে। এতে প্রাণহাণিরও সমূহ সম্ভাবনা ছিল। পুলিশ তখন জায়গা খালি করার সিদ্ধান্ত নেয় ও লাঠিচার্জ শুরু করে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, লাঠিচার্জের আগে সকালে প্রথম দফা হামলা হওয়ার পর এমপি মহোদয়কে অনুরোধ করা হয়েছিল তার সমর্থকদের সামলে রাখতে। তা না করে তারা চড়াও হন পুলিশের ওপর। তখন এমপি বলেন, ‘আমি দেখছি কারা গাড়ির কাঁচ ভাঙল, গাড়ির কাঁচের দাম কত, এটা ঢাকায় পাওয়া যাবে না?’
লাঠিচার্জের একটা প্রক্রিয়া আছে : সাবেক আইজিপি
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুলিশের লাঠি জনগণের টাকায় কেনা, এটা কতটুকু লম্বা হবে, কতটুকু মোটা হবে, এর ব্যবহার কীভাবে করতে হবে তা নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। পুলিশ কখন লাঠি ব্যবহার করে লাঠিচার্জ করবে এটা নিয়ে পুলিশ একাডেমিতে বেসিক ট্রেনিং দেওয়া হয়। যখন কোনো অবৈধ জনতা ভাঙচুর, মারামারি বা পুলিশের ওপর হামলা করে তখন তাদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দিতে হয় যাতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হয়। লাঠিচার্জে কাজ না হলে টিয়ার গ্যাস ছুড়তে হবে, ওয়াটার ক্যানন ব্যবহার করতে হবে। তাতেও কাজ না হলে শটগান ব্যবহার করতে হবে। এভাবে ছত্রভঙ্গের বিভিন্ন ধাপ আছে।’
বরগুনার ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি বরগুনার ঘটনায় যতগুলো ভিডিও দেখলাম, সেখানে কর্মীরা কিন্তু ভয়ে পালাচ্ছিল। তারপরও পুলিশ পেটাচ্ছিল। ভিডিওতে আমি কাউকে বিক্ষোভ, ভাঙচুর অথবা পুলিশকে মারতে বা নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে দেখিনি। তারা তো এমনিতেই ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। যে ব্যক্তি ভয়ে পালাচ্ছিল তাকে পেটানোর দরকার কি? আমার মতে এটা ঠিক হয়নি। এটা আন-ল’ ফুল (আইনবিরোধী) কাজ হয়েছে।
কী ঘটেছিল সেদিন
১৫ আগস্ট সোমবার দুপুর ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম শাহাদৎবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্সে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে ফেরার সময় শিল্পকলা একাডেমির সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর পদবঞ্চিতরা হামলা চালায়। এ সময় দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের মধ্যেই পুলিশ ছাত্রলীগ কর্মীদের লাঠিচার্জ করে সরিয়ে দেয়। এ সময় সেখানে বরগুনা-১ আসনের এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুসহ আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এআর/জেডএস