সিআইডির ব্রিফিং

গোপালগঞ্জের গোপিনাথপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার হামিদুল হক ছিলেন বাকপটু। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এই মেম্বার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এনেছিলেন অনাস্থা প্রস্তাব। একই পাড়ার বাসিন্দা রবি শরীফ চেয়েছিলেন তার ভাইকে মেম্বার পদে প্রার্থী করবেন। সেজন্য হামিদুলকে সরানো দরকার। এদিকে লাচ্চু চেয়ারম্যান আমির মোল্লার নামে অপহরণ মামলা করায় তাকে শায়েস্তার পরিকল্পনা করছিলেন আমির। এমন প্রেক্ষাপটে আধিপত্য আর প্রতিশোধের নীল নকশায় দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় মেম্বার হামিদুলকে।

পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক গত ১২ ডিসেম্বর (শনিবার) আনুমানিক সন্ধ্যা সোয়া ৭ টার দিকে গোপালগঞ্জ জেলার গোপিনাথপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার হামিদুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়।

ঘটনার পর গত ১৪ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং-১৩। ঘটনার পরপরই সিআইডি ছায়া তদন্ত শুরু করে। আধুনিক তদন্ত কলাকৌশল ব্যবহার করে সিআইডি প্রথমে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা মোটরসাইকেলের (গোপালগঞ্জ ল-১১-১৪৮১) মালিক ও চালক আমির মোল্লাকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করে।

পরে আমির মোল্লার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যার মূল আসামি রবিউল শরীফকে (৫৭) গ্রেফতারের জন্য সিআইডি যশোর ও গোপালগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করে।

সোমবার দিনগত রাত ১১টার দিকে সিআইডির এলআইসি শাখার সহযোগীতায় পুরোনো ঢাকার পাটুয়াটুলী থেকে প্রত্যক্ষভাবে হত্যায় জড়িত রবিউল শরীফকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় সিআইডি। তবে হত্যায় ব্যবহার করা অস্ত্রের যোগানদাতা ও অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দফতরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডি’র ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ঈমাম হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিআইডি’র এলআইসি শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুক্তা ধর ও এএসপি (মিডিয়া) জিসানুল হক।

ঈমাম হোসেন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ, কারিগরি তথ্য, রূপসা ব্রিজে টোল প্লাজার সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ এবং মনিরের (যশোর) পেট্রোল পাম্পের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মূল আসামি রবি শরীফ (৫৭) গত ১১ ডিসেম্বর (শুক্রবার) তার পূর্ব পরিচিত যশোরের চশমার দোকানদার আমির মোল্লাকে মোটরসাইকেলে নিয়ে যশোর থেকে গোপালগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা করেন।

মোটরসাইকেল (গোপালগঞ্জ ল-১১-১৪৮১) নিয়ে যশোর সদর হাসপাতালের সামনে আনুমানিক দেড়টার সময় তারা অপেক্ষা করতে থাকেন। এ সময় রবি শরীফ কালো ব্লেজার, জিন্স প্যান্ট এবং সাদা সার্জিকাল মাস্ক পরা ছিলেন। সেখান থেকে তারা দুপুর ২ টা ৫ মিনিটে যশোরের মনিরুদ্দিন পেট্রোল পাম্পে তেল নিতে যান। 

পরে গোপালগঞ্জে যাওয়ার পথে কালনাঘাটের একটি চায়ের দোকানে চা পান করে গোপালপুর বাজারে কিছু সময়ের বিরতি নেন তারা। এ সময় মূল আসামি মোটরসাইকেল থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বিভিন্ন লোকের সঙ্গে  কথা বলেন।

হামিদুল হক মেম্বার ভ্যানচালক সাগরকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করে মায়ের জন্য ঔষধ আনতে যান। এসময় তিনি স্থানীয় মিজান মেম্বার ও পলাশ শেখের সাথে গল্প করেন। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে ভ্যানযোগে হাইস্কুল গেটের সামনে আসেন তিনি। এসময় গোপিনাথপুর বাজার থেকে রবি শরীফ (৫৭) মোটরসাইকেলে  গোপিনাথপুর হাইস্কুলের গেটের সামনে এসে রাস্তার পূর্ব পাশে পৌছান। তিনি মোটরসাইকেল দিয়ে মেম্বারের  ভ্যান আটকে দেন। এরপর মোটরসাইকেলে বসা রবি শরীফ ভ্যানে বসা হামিদুল হক মেম্বারকে অত্যন্ত কাছ থেকে পিস্তল দিয়ে বুকের বাম পাশে চারটি গুলি করেন। সঙ্গে সঙ্গে হামিদুল মেম্বার রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। 
হত্যার পর আসামি রবি শরীফ মোটরসাইকেল চালক আমির মোল্লাকে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যান। ঘটনার পর ভ্যানচালক সাগর ভিকটিমকে হাসপাতালে নিয়ে যান।

যশোর যাওয়ার পথে রূপসা ব্রিজের টোল প্লাজার সিসি ক্যামেরায় তাদের অবস্থানের বিষয়টি আনুমানিক রাত ৮টায় ধরা পড়ে। সেখান থেকে যশোরের দড়াটোনা মোড়ে এসে রবি শরীফ নামেন। সেখানে রুটি কিনে রবি শরীফ ফের মোটরসাইকেলে যশোরের গোপ পাড়া রোডে যান।

রাত সাড়ে ৯ টার সময় তিনি তার মোবাইল ফোন আবার চালু করেন। অজ্ঞাত অস্ত্রদাতার কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে তারা নিজ নিজ বাসায় চলে যান।

মেম্বার হামিদুলকে হত্যা কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঈমাম হোসেন বলেন, খুনিরা পেশাদার না। তবে স্থানীয় আধিপত্য ও ক্ষমতা বিস্তারের জেরে হত্যা করা হয় হামিদুলকে।

তিনি বলেন, রবিউল শরীফ চেয়েছিলেন নিজের ভাইকে মেম্বার বানাবেন। তবে সে পথে কাটা প্রভাবশালী মেম্বার হামিদুল। হত্যায় জড়িত অন্য আসামি আমির মোল্লা ছিলেন স্থানীয় চেয়ারম্যান লাচ্চুর করা অপহরণ মামলার আসামি। আবার সম্প্রতি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন নিহত মেম্বার হামিদুল।

হামিদুল মেম্বারকে সরালে রবি তার ভাইকে মেম্বার পদে প্রার্থী করতে পারবেন। অন্যদিকে আমির এই সুযোগে জল ঘোলা করে চেয়ারম্যানকে শায়েস্তা করতে পারবেন। সব মিলে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চিন্তা থেকেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় হামিদুল মেম্বারকে।

এই হত্যায় অন্য কারো ইন্ধন সহযোগীতা বা যোগসাজশ ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান লাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পাশাপাশি হত্যায় ব্যবহার করা অস্ত্রের যোগানদাতাকে গ্রেফতার ও অস্ত্র ‍উদ্ধারের জোর প্রচেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।

জেইউ/এইচকে