দুদকের আসামি ৫০
উত্তরপত্র ঘষা-মাজায় পাস, তারপরও খাদ্য পরিদর্শক তারা
শরীয়তপুরের তাজুল ইসলামের নিয়োগ লিখিত পরীক্ষার ওএমআর শিটে ৫৫ নম্বর পেলেও চাকরি দিতে ঘষা-মাজায় দেওয়া হয় ৮৯ নম্বর। এমনকি পরীক্ষার খাতায় প্রাপ্ত নম্বর ৮ হলেও ঘষা-মাজায় এক প্রার্থীকে দেওয়া হয় ৮৯। এরপর যথারীতি পাস এবং চাকরি।
একইভাবে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের মো. জহিরুল ইসলাম পরীক্ষার খাতার নম্বর ৫০, কিন্তু চাকরি দিতে তার প্রাপ্ত নম্বর বানানো হয় ৯০, ফরিদপুরের বোয়ালমারীর আসমা রহমানের ওএমআর শিটের ৪৮ নম্বর ৮৯ ও সিলেট সদর উপজেলার অপূর্ব কুমার রায়ের ২৫ নম্বরকে দেখানো হয় ৯০।
বিজ্ঞাপন
একই প্রক্রিয়ায় অযোগ্য প্রার্থীদের বেশি নম্বর দিয়ে খাদ্য পরিদর্শক পদে ৪৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে এমন ভয়াবহ জালিয়াতির পর মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি উত্তীর্ণদের নাম ঘোষণা করে চাকরি দেওয়া হয়। এখনও ৪৩ জন খাদ্য পরিদর্শক দিব্যি চাকরি করে যাচ্ছেন।
দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে এসব তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। যেখানে বাছাই কমিটির সদস্য ও পরীক্ষা নেওয়ার আইটি সার্ভিস দেওয়া প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানার্স অ্যান্ড কনসালটেন্টসের কর্মকর্তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা মিলেছে।
বিজ্ঞাপন
লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়া বা কম নম্বর পাওয়া ৪৪ পরীক্ষার্থীর লিখিত পরীক্ষার ওএমআর সিটে প্রাপ্ত নম্বর জালিয়াতির মাধ্যমে বেশি নম্বর বসিয়ে ৮০ ও তার বেশি নম্বর দিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ওই ৪৪ জন পরীক্ষার্থীসহ মোট ৩২৮ জনকে খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হওয়ার পর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগ থানায় দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক মো. মনিরুল হক বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
আরও পড়ুন: ফারইস্টের এমডি-পরিচালকসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন
এরপর দীর্ঘ সাত বছরের তদন্ত শেষে সম্প্রতি ওই মামলার চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। অনুমোদিত চার্জশিটে অবশ্য মামলা থেকে দুই জন আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে ৫০ জনকে রাখা হয়েছে। শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে।
অনুমোদিত চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন— বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও খাদ্য বিভাগের সাবেক উপ-সচিব নাসিমা বেগম, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ও সাবেক উপ-পরিচালক (সংস্থাপন) ইফতেখার আহমেদ, খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ) ইলাহী দাদ খান এবং ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানার্স অ্যান্ড কনসালটেন্টসের ম্যানেজার মো. আইউব আলী, সাবেক সিস্টেম এনালিস্ট ও টেকনিক্যাল ম্যানেজার আসাদুর রহমান, সাবেক হার্ডওয়ার ইঞ্জিনিয়ার মো. আরিফ হোসেন এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাটাবেজ অ্যাডমিন মো. আবুল কাসেম।
চাকরি পাওয়া ৪৩ খাদ্য পরিদর্শক হলেন— শরীয়তপুর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, সিলেট কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মো. জহিরুল ইসলাম, সিলেট সদরের খাদ্য পরিদর্শক অপূর্ব কুমার রায়, সাভার উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক আবু জাকির মোহাম্মদ রিজওয়ানুর রহমান, ফরিদপুর বোয়ালমারী উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক আসমা রহমান, মানিকগঞ্জ হরিরামপুরের খাদ্য পরিদর্শক আসমা ইসলাম, সিলেট বিয়ানীবাজারের খাদ্য পরিদর্শক জাহানারা জলি, শেরপুর নয়াবিল টিপিসির খাদ্য পরিদর্শক অলিউর রহমান, জামালপুর সদর উপজেলাল খাদ্য পরিদর্শক সানজিদা সুলতানা, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার উম্মে হানী, সিলেট বিশ্বনাথ উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ মোহাইমিনুল ইসলাম ভূঞা, হবিগঞ্জ আজমিরীগঞ্জের খাদ্য পরিদর্শক প্রতাপ কুমার সরকার, পাবনা চাটমোহর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক কোহিনুর আক্তার, সুনামগঞ্জ ধর্মপাশার খাদ্য পরিদর্শক মির আরিফুর রহমান, নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব, ময়মনসিংহ গয়েশপুর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মো. সাজ্জাদ হোসেন খান পাঠান, নেত্রকোণা সদর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক হিমেল চন্দ্র সরকার, ঢাকা সিএসডির খাদ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ রইছ উদ্দিন, শেরপুর সদর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক সালমা আক্তার, জামালপুর এলএসডির খাদ্য পরিদর্শক শামছুন নাহার, টাঙ্গাইল ঘাটাইলের খাদ্য পরিদর্শক ইয়াসির আরাফাত, টাঙ্গাইল নাগরপুর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মো. এদিব মাহমুদ, পটুয়াখালী গলাচিপা উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক হালিমা আহমেদ, ঝালকাঠি সদর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, কুমিল্লা বরুড়া উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ তৈয়ব উল্যাহ খান, নওগাঁ ধামুইরহাট উপজেলার শেখ মো. জাকারিয়া হাসান, নওগাঁ বদলগাছীর মোহাম্মদন নুরুজ্জামান, নওগাঁ পোরশা উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মো. আতিকুর রহমান, বগুড়া শিবগঞ্জ উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মোছা. মমতাজ বেগম, জামালগঞ্জ এলএসডির খাদ্য পরিদর্শক কানিজ শারমিন, পাবনা আটঘরিয়া উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মো. জুনায়েদ কবীর, মানিকগঞ্জ সিংগাইর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক সেলিনা আক্তার, সিরাজগঞ্জ কাজীপুর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিঞা, রংপুর মিঠাপুকুরের খাদ্য পরিদর্শক মোছা. জাকিয়া সুলতানা, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক অনিমেষ কুমার সরকার, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার মোছা. জেসমিন আক্তার, নীলফামারী সৈয়দপুর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মো. রায়হান কবির, রংপুর পীরগঞ্জ মিঠাপুকুর টিপিসির খাদ্য পরিদর্শক মো. শরিফুল ইসলাম, সাতক্ষীরা দেবহাটার খাদ্য পরিদর্শক বিল্লাল হোসেন, বাগেরহাট মংলা উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মো. আবুল হাশেম, পটুয়াখালী কাঠালতলি উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক ইসরাত জাহান মনা, বরগুনা সদর উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক আরিফা সুলতানা এবং সুনামগঞ্জ দিরাই উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক আশীষ কুমার রায়।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, তদন্তকালে জানা যায়, খাদ্য অধিদপ্তরের ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরে ৩য় শ্রেণির ১০ ক্যাটাগরিতে (খাদ্য পরিদর্শক, উপ-খাদ্য পরিদর্শক, সহকারী উপ-খাদ্য পরিদর্শক, সুপার ভাইজার, অডিটর, উচ্চমান সহকারী, হিসাব রক্ষক কাম ক্যাশিয়ার, অফিস সহকারী কাম-মুদ্রাক্ষরিক, ডাটা এন্ট্রি/কন্ট্রোল অপারেটর, সহকারী অপারেটর) ১ হাজার ৫৫২টি শূন্য পদ পূরণের জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এরপরই খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ইলাহী দাদ খানকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। খাদ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ পরীক্ষায় নম্বর নির্ধারণ, প্রশ্নপত্র তৈরি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল প্রকাশসহ যাবতীয় কাজ বিভাগীয় নির্বাচন/বাছাই কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।
২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি বিভাগীয় নির্বাচন/বাছাই কমিটির সভা শেষে উত্তীর্ণদের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু দুদকের তদন্তে দেখা যায়, বাছাই কমিটির সদস্য ও ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানার্স অ্যান্ড কনসালটেন্টসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়া বা কম নম্বর পাওয়া ৪৪ পরীক্ষার্থীর লিখিত পরীক্ষার ওএমআর সিটে প্রাপ্ত নম্বর জালিয়াতির মাধ্যমে বেশি বসিয়ে ৮০ ও তদূর্ধ্ব নম্বর দিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিভাগীয় নির্বাচন/বাছাই কমিটির সদস্যদেরও ওই তালিকায় স্বাক্ষর পাওয়া যায়। যেখানে আসামি ৪৪ জন পরীক্ষার্থীসহ মোট ৩২৮ জনকে খাদ্য অধিদপ্তরের খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দুদক দণ্ডবিধির ৪১৮/৪২০/৪৭৭(ক)/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় চার্জশিট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব ও বাছাই কমিটির সদস্য রোকেয়া খাতুন, ঢাকা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (উপ-সচিব) ও সরকারি কর্ম-কমিশন সচিবালয়ের সাবেক উপ-পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান ফারুকীকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আরএম/এসএসএইচ