অফিসের বাইরে পরিবার সামলানো, সন্তানকে সময় দেওয়া, রান্নাবান্না— সব মিলে কর্মজীবী নারীর নিজের বলে কোনো সময় থাকে না। অন্যকে সেবা দিয়েই আত্মতৃপ্তি খুঁজতে হয়। তবে ‘আমি নারী’ এমন কথা শোনা খুবই অসম্মানের। এই সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না। ‘নারী’ হিসেবে ভাবার আগে আমাকে ‘মানুষ’ হিসেবে ভাবা হোক। আর পেশায় আমি পুরুষ সহকর্মীর প্রতিদ্বন্দ্বী নই, সহযোদ্ধা। সব পেশার পুরুষ সহকর্মীর উচিত তা অনুধাবন করা।

১৯৯৯ সালে ২৫ জানুয়ারি ১৮তম বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন শামীমা বেগম। পেশাগত জীবনে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। টাঙ্গাইলের পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (পরিবহন) হিসেবে। ২০০৬-০৭ সালে আইভরিকোস্টে এবং ২০১০-১১ সালে সুদানে জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত দক্ষতার জন্য পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদকও (পিপিএম)। শামীমা বেগম বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের (বিপিডব্লিউএন) সহ-সভাপতি ও আইএডব্লিওপির রিজিয়ন-২২ এর কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন

নারী দিবস উপলক্ষে নিজ কার্যালয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার শামীমা বেগম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন।
 
ঢাকা পোস্ট : নারীর ক্ষমতায়ন, অধিকার, পদায়ন নিয়ে আলোচনা বেশি হয় নারী দিবসে। রাষ্ট্র কি নারীর যোগ্যতা-অধিকারের প্রশ্নে গুরুত্ব দিচ্ছে?

শামীমা বেগম : উন্নত দেশের পরিকল্পনা নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। পলিসি লেভেলে সে ধরনের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতায়নে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও তা হয়তো দৃশ্যমান নয়। তবে পেছনে তাকালে তা স্পষ্ট হয়। আমরা সবাই যদি জেন্ডার সংবেদনশীলতা নিয়ে কাজ করি তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব, নারী প্রশ্নে সব বৈষম্য দূর করাও সম্ভব।

ক্ষমতায়নে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও তা হয়তো দৃশ্যমান নয়। তবে পেছনে তাকালে তা স্পষ্ট হয়। আমরা সবাই যদি জেন্ডার সংবেদনশীলতা নিয়ে কাজ করি তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব, নারী প্রশ্নে সব বৈষম্য দূর করাও সম্ভব

শামীমা বেগম, যুগ্ম কমিশনার, ডিএমপি

ঢাকা পোস্ট : পুলিশে নারীর দুয়ার প্রশস্ত হয়েছে। যদিও শতাংশের হিসাবে পিছিয়ে নারীরা। এর পেছনের কারণ কী? এটা প্রাতিষ্ঠানিক কারণে নাকি নারীর যোগ্যতার জন্য হচ্ছে?

শামীমা বেগম : আমরা পর্যায়ক্রমে সামনের দিকে যাচ্ছি। শুধু সরকারি সিদ্ধান্তেই নারীকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সামাজিক কাঠামো, সমাজব্যবস্থা; সেখানেও পরিবর্তন আনতে হবে। পুলিশে কিন্তু আগের তুলনায় উন্নতি ঘটেছে। একটা সময় পুলিশে প্রায় ১০ বছর ক্যাডার সার্ভিস বন্ধ ছিল। সে দুয়ার খুলেছে। পুলিশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করছেন নারীরা। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখন নারীর সুযোগ পর্যাপ্ত।

পুলিশ একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। এটা মনে করে অনেকেই আসতে চান না। সমাজে বা পরিবারে এখনও এই ধারণা আছে, পুলিশিং মানে শুধু পুরুষের কাজ। এই যে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা, সেটাই বড় বাধা। এই চিন্তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

আর সংবেদনশীল পুলিশিং ব্যবস্থার জন্য থানাপর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী সদস্য পদায়ন করা উচিত। এই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। যেমন— এবার মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রতিটি থানায় নারী ও শিশু নির্যাতিতদের সেবা দেওয়ার জন্য আলাদা ডেস্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

সংবেদনশীল পুলিশিং ব্যবস্থার জন্য থানাপর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী সদস্য পদায়ন করা উচিত। এই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। যেমন— এবার মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রতিটি থানায় নারী ও শিশু নির্যাতিতদের সেবা দেওয়ার জন্য আলাদা ডেস্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে

শামীমা বেগম, যুগ্ম কমিশনার, ডিএমপি

ঢাকা পোস্ট : কিছু চাঞ্চল্যকর নারী নির্যাতন, হত্যা মামলা, মাদক সংশ্লিষ্টতায় পুরুষ কর্মকর্তার অবহেলা বা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ক্লিন ইমেজ ধরে রেখেছেন নারী কর্মকর্তারা। এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

শামীমা বেগম : একই ভুল যদি কোনো পুরুষ কর্মকর্তা বা সদস্য করেন তা নিয়ে যতটা না বিদ্রূপ বা বিরূপ মন্তব্য করা হয় নারীর ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি হয়। এই জায়গায় নারীরা অধিক শ্রম ও মেধার পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি গর্বিত যে, এই চেষ্টাটা আমার জুনিয়র-সিনিয়ররা অনেক পেশাদারিত্বের সঙ্গে করে যাচ্ছেন। সেবার জন্য আমার পদায়ন। ‘জনস্বার্থে নিয়োগ’ লেখা থাকে নিয়োগপত্রে। আমাদের সেটাই হওয়া উচিত মূলমন্ত্র, চালিকাশক্তি।

ঢাকা পোস্ট : কর্মজীবী নারীদের কাজের ক্ষেত্রটা কতটা সহজ, আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে যদি বলতেন...

শামীমা বেগম : ভালো কাজের জন্য ভালো কর্মপরিবেশ জরুরি। পুলিশে কোনো কর্মঘণ্টা নেই। ২৪ ঘণ্টাই কর্মঘণ্টা। নারীদের জন্য যে ধরনের বিশেষায়িত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন তা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময় আমরা দাবি জানিয়েছি। সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে। নারীদের জন্য আলাদা ব্যারাক হচ্ছে। নিরাপত্তার স্বার্থে একা কোনো নারী সদস্যকে ডিউটিতে পাঠানো হচ্ছে না। ডে কেয়ার বা বেবি কেয়ার সেন্টার থাকলে সেটা আরও সুবিধার হয়। বিশেষ করে যেসব নারী সার্জেন্ট রাস্তায় কাজ করছেন, তাদের ফ্যাসিলিটিজের (সুযোগ-সুবিধা) প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ সংক্রান্ত আমরা ছয়টি জেন্ডার নির্দেশিকা বা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এ থেকে স্পষ্ট, পুলিশ জেন্ডার সংবেদনশীলতাকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি কমিউনিটিতে এবং পুরুষ সহকর্মীদের মধ্যেও যেন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, সেজন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কোর্স সংযুক্ত করা হয়েছে।

শামীমা বেগম, যুগ্ম কমিশনার, ডিএমপি
অনেক শিক্ষিত নারী সংসারে মন দিচ্ছেন। বিয়ের আগে চাকরি করেছেন। বিয়ের পর ছেড়ে দিচ্ছেন। এটা দুঃখজনক। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরে বা সংসারে রেখে উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়

শামীমা বেগম, যুগ্ম কমিশনার, ডিএমপি

ঢাকা পোস্ট : শিক্ষাগত জীবনে উজ্জ্বল অনেক নারী বৈবাহিক জীবনে পা রেখে হারিয়ে যাচ্ছেন। কেন? এটা কি নারীর দুর্বলতা নাকি সামাজিক-পারিবারিক মানসিকতার কারণ?

শামীমা বেগম : এটা বাস্তব যে, অনেক শিক্ষিত নারী সংসারে মন দিচ্ছেন। বিয়ের আগে চাকরি করেছেন। বিয়ের পর ছেড়ে দিচ্ছেন। এটা দুঃখজনক। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরে বা সংসারে রেখে উন্নত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। বরং দেশ, রাষ্ট্রের সর্বোপরি নিজের প্রয়োজনে সংসার-বাচ্চা-কাচ্চা সামলে কর্মে মনোনিবেশ করা উচিত। টেকনিক্যাল বিষয়ে নারীদের প্রশিক্ষণ দিলে কাজের ক্ষেত্র সহজ হবে বলে মনে করি।

ঢাকা পোস্ট : পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আপনার ব্যস্ততা অনেক। পাশাপাশি মা, স্ত্রী বা সন্তান হিসেবেও দায়িত্ব রয়েছে। কীভাবে সামলে নেন?

শামীমা বেগম : কর্মজীবীর কোনো অবসর নেই। ২৪ ঘণ্টাই কর্মদিবস। সেভাবেই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। অফিস টাইমের বাইরে পরিবারের জন্য পরিকল্পনা করে কাজ করতে হয়। সন্তানকে সময় দেওয়া, রান্নাবান্না…। আসলে কর্মজীবী নারীর নিজের জন্য সময় থাকে না। অন্যকে সার্ভিস দিয়ে আত্মতৃপ্তি খুঁজে নিতে হয়।

আসলে কর্মজীবী নারীর নিজের জন্য সময় থাকে না। অন্যকে সার্ভিস দিয়ে আত্মতৃপ্তি খুঁজে নিতে হয়

শামীমা বেগম, যুগ্ম কমিশনার, ডিএমপি

ঢাকা পোস্ট : নারীদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত কী?

শামীমা বেগম : নারীকে আগে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। নিজের কাজের উন্নতির জন্য জ্ঞান ও আচরণকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আগে সংবেদনশীল করতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : নারীর অধিকার বা সমতা প্রতিষ্ঠায় সংরক্ষিত কোটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

শামীমা বেগম : কোনো পেশায় নারী-পুরুষ সমতা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষদের পদায়ন বেশি। এটার মানে এই নয়, নারী মেধাবী নয়। কোটা রেখে করুণা করাও নয়। রিজার্ভ কোটায় নারীকে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়কে আমরা উদারভাবে চিন্তা করতে পারি।

নারীকে আগে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। নিজের কাজের উন্নতির জন্য জ্ঞান ও আচরণকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আগে সংবেদনশীল করতে হবে

শামীমা বেগম, যুগ্ম কমিশনার, ডিএমপি

ঢাকা পোস্ট : আপনার এই অবস্থানে আসার ক্ষেত্রে মা-বাবা ও স্বামীর ভূমিকা সম্পর্কে যদি বলতেন…
 
শামীমা বেগম : বাবার অনুপ্রেরণায় ১৯৯৯ সালে আমি পুলিশে যোগ দেই। তবে বাবা বলেছেন, তোমার এই পেশা হবে অনেক চ্যালেঞ্জিং। মনে করে নিও তোমাকে খারাপ জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই তোমাকে ভালো কিছু করতে হবে। টিকে থাকতে হবে। এ কথাগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার স্বামীও ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার। নিজেদের বোঝাপড়াটা খুবই ভালো। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

তবে মায়ের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। আমরা আট ভাই-বোন। আমি যখন এএসপি হই, গ্রামের মানুষ মাকে বলত এসপির মা। এই ধরনের কথা আমাকে যখন মা শোনাতেন খুব আবেগতাড়িত হতাম।

ঢাকা পোস্ট : আপনাকে ধন্যবাদ ঢাকা পোস্টকে সময় দেওয়ার জন্য।
 
শামীমা বেগম : ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ।

জেইউ/এমএআর/এফআর/এমএমজে