‘খেলার সুবিধা তৈরি না করলে উন্নত জাতি গড়া সম্ভব নয়’
নগর ও গ্রামীণপর্যায়ে খেলার সুবিধা তৈরি করতে না পারলে উন্নত জাতি গড়া সম্ভব নয় বলে নগর সংলাপে মত দিয়েছেন আলোচকরা। সোমবার (৫ ডিসেম্বর) ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের নগর ও গ্রামীণ এলাকায় খেলার মাঠের সংকট ও করণীয়’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় বক্তারা এ কথা বলেন।
আলোচকরা বলেন, আমাদের শিশু-কিশোরসহ সবার সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য খেলার মাঠের গুরুত্ব অপরিসীম বলে বিবেচ্য হলেও আমাদের দেশের নগর কিংবা গ্রাম সব এলাকাতেই খেলাধুলা করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠে অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণ কিংবা বিভিন্ন ক্লাব ও স্বার্থান্বেষী মহলের দখলের কারণে শিশু-কিশোর ও এলাকাবাসীরা খেলাধুলার সুযোগ থেকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
আইপিডির নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমাদের গ্রামীণ এলাকায় পরিকল্পিত খেলার মাঠ নেই। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ এক্ষেত্রে বিনোদন সুবিধার চাহিদা পূরণ করে। গ্রামে মেয়েদের খেলার মাঠ না থাকায় তাদের খেলার সুযোগ অপ্রতুল। নগর এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে খেলার মাঠের সংখ্যা খুবই কম। এখানকার অনেক মাঠ বিভিন্ন ক্লাব বা প্রভাবশালী মহলের দখলে।
নগর এলাকায় বেশকিছু খেলার মাঠের উন্নয়ন কার্যক্রম হলেও উন্নয়নের পর সেগুলোতে জনসাধারণের প্রবেশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে- অভিযোগ তার।
বিজ্ঞাপন
আইপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একটি করে শিশুদের (৩-৬ বছর) খেলার মাঠ (প্লে লট), কিশোরদের জন্য (৭-১২ বছর) প্লে-গ্রাউন্ড এবং বড়দের জন্য (১৩ ঊর্ধ্ব বয়সী) প্লে-ফিল্ডের সুবিধা থাকতে হয়। আমাদের নগর এলাকার জনসংখ্যার আকার ও ধরন অনুযায়ী নগর এলাকায় খেলার মাঠের তীব্র সংকট আছে।
ঢাকা মহানগরীতে খেলার মাঠের ঘাটতি ৭৯৫, চট্টগ্রামে ৫৪১, রাজশাহীতে ৩৭, খুলনাতে ৬৬, সিলেটে ৩২ ও বরিশালে ৩৪টি। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নগর ও গ্রামীণ এলাকায় সবার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক খেলার মাঠ তৈরি করা না গেলে আমাদের স্বাস্থ্যগত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত প্রজন্ম তৈরি হবে। জাতিগতভাবে যার মূল্য হবে ভয়াবহ।
আইপিডি উপদেষ্টা ও পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, খেলার মাঠ আমাদের সামাজিকীকরণ বাড়ায়। উদারচিত্ত হৃদয়ের মানুষ গড়তে সহায়তা করে। খেলাধুলাবিহীন আত্মকেন্দ্রিক মানুষরা কীভাবে আমাদের জন্য সার্বজনীন বাংলাদেশ গড়তে নেতৃত্ব দিবে? নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে পরিকল্পনামাফিক খেলার মাঠ ও যোগ্য সংগঠক তৈরি করতে হবে আমাদের।
বাংলাদেশে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা বলেন, পুরান ঢাকার যেসব এলাকায় আমরা খেলাধুলা করে বড় হয়েছি, তার অধিকাংশেই এখন খেলার সুযোগ নেই। খেলার মাঠ নিয়ে আন্দোলন করেও সেগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না। পাড়া-মহল্লায় খেলাধুলা করার সুযোগ না পেলে আমাদের শিশুরা কীভাবে সুস্থ থাকবে?
শেলটেক কনসালটেন্টস লিমিটেডের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা ও পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে নগর এলাকায় একের পর এক খেলার মাঠ ধ্বংস করা হচ্ছে। অথচ আমরা আমাদের শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক মূল্য নিরূপণ করতে বেমালুম ভুলে গেছি।
ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল বলেন, শুধু ঢাকা শহরের খেলার মাঠই নয়, ধ্বংস হয়েছে নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বেশির ভাগ শহরের খেলার মাঠ। ফলে আগে সারাদেশের পাড়া-মহল্লা-এলাকার মাঠ থেকে যেভাবে খেলোয়াড় তৈরি হতো, সেটা এখন আর সেভাবে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ বলেন, ছোটবেলায় মতিঝিলের যেই জায়গায় বন্ধুদের নিয়ে খেলতাম, তা এখন বহুতল ভবন ‘সিটি সেন্টার’। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়মুক্ত হতে এখন সময় এসেছে খেলার মাঠ নিয়ে বড় রকমের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার।
বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় আফিদা খন্দকার বলেন, ছোটবেলায় যেসব মাঠে আমাদের খেলাধুলা করবার সুযোগ ছিল, সেগুলোর অধিকাংশই এখন আর নেই। খেলাধুলার সুযোগের অভাবে ছেলে-মেয়েরা মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, প্রতিটি নেইবারহুড তথা পাড়ায় বিভিন্ন বয়সের চাহিদা অনুযায়ী খেলার মাঠ গড়ে তোলা দরকার।
এএসএস/এমটিআই