বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি আছে এমন এলাকায় শিশুদের মল এবং পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী এশেরিকিয়া কোলাইয়ের (ই-কোলাই) উচ্চ প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা গেছে।

এছাড়াও কম আর্সেনিক দূষণযুক্ত অঞ্চলের তুলনায় খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেশি, এমন এলাকায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ বেশি দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ- আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী এবং সহযোগীদের একটি নতুন গবেষণায় এই চিত্র দেখা গেছে।

বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছে আইসিডিডিআর,বি। গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি ‘প্লস প্যাথোজেন’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ বিশ্বব্যাপী মানুষের হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। যদিও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের প্রধান কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যাধিক ব্যবহার এবং অপব্যবহার, কিন্তু প্রাকৃতিক উপাদান যেমন ভারী ধাতুগুলোও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণ হতে পারে।

গবেষকরা চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ ও মতলব উপজেলার ১০০টি পরিবারের (প্রত্যেক উপজেলায় ৫০টি) মা ও শিশুদের মল এবং খাবার পানির নমুনা সংগ্রহ করেছেন। হাজীগঞ্জে বসবাসকারী পরিবারের মানুষজন অগভীর নলকূপের পানীয় পান করে। এখানকার পানিতে আর্সেনিকের উচ্চমাত্রা পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, মতলবের পরিবারের সদস্যরা আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ থেকে তাদের খাবার পানি সংগ্রহ করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, হাজীগঞ্জের ৫০টি পানির নমুনায় মেডিয়ান আর্সেনিকের ঘনত্ব ছিল ৪৮১ μg/L, যেখানে খাবার পানিতে আর্সেনিকের সর্বোচ্চ সীমা ১০ μg/L হওয়া উচিত। অন্যদিকে, মতলবের ৫০টি নমুনায় মেডিয়ান আর্সেনিকের ঘনত্ব ছিল ০ μg/L। সামগ্রিকভাবে, দুটি এলাকার ৮৪ শতাংশ পানি এবং মলের নমুনায় ই-কোলাই উপস্থিতি পাওয়া গেছে। 

মতলবের (২২ শতাংশ, p<০.০৫) পানির তুলনায় হাজীগঞ্জে (৪৮ শতাংশ) পানিতে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ই-কোলাইয়ের প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দেখা যায় এবং হাজীগঞ্জের ৯৪ শতাংশ শিশুর দেহে ব্যাকটেরিয়াটির উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা মতলবের শিশুদের ক্ষেত্রে ৭৬ শতাংশ (p<০.০৫)। তবে কোনো এলাকার মায়েদের মধ্যে ই-কোলাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এছাড়াও, হাজীগঞ্জের ই-কোলাইয়ের উচ্চতর অনুপাত পেনিসিলিন, সেফালোস্পোরিন এবং ক্লোরামফেনিকলসহ একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ছিল।

গবেষকরা আশঙ্কা করেছেন যে, বাংলাদেশে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাবযুক্ত এলাকার শিশুদের দেহে আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের মধ্যকার সম্পর্ক জনস্বাস্থের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়। ফলে আর্সেনিকের প্রভাব ও বিস্তার কমানোর প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।

গবেষণার প্রধান গবেষক আইসিডিডিআর,বি-র অ্যাডজাঙ্কট সায়েন্টিস্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতু পরিবেশে অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল। এসব ধাতু দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাকটেরিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যার ফলাফল হিসেবে মানুষের মধ্যে অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্ট্যান্স গড়ে উঠছে।

তিনি আরও বলেন, এর ফলে কখনও অ্যান্টিবায়োটিক নেয়নি, তবে আর্সেনিকের মতো ধাতুর সংস্পর্শে এসেছে এমন মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণির দেহে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী বিভিন্ন অণুজীব তাদের বসতি গড়ে তুলতে পারে। অন্যান্য কনফাউন্ডারের তুলনায় গবেষণা থেকে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের যে ফলাফল পেয়েছি সেটি নিয়ে আরও গবেষণা করলে অনেক বেশি উপকার পাওয়া সম্ভব। তবে, পরিবেশে যাতে ভারী ধাতুর প্রভাবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখার পাশাপাশি ওষুধ ও কৃষিতে অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ব্যবহারে দায়িত্বশীল হতে হবে।

‘আমাদের বর্তমান গবেষণার ফলাফলগুলো বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন পরিবেশে সীসা, পারদ ও লোহার মতো অন্যান্য ভারী ধাতুর প্রভাব সম্পর্কে আরও অনুসন্ধান করার এখনই সঠিক সময়, -উল্লেখ করেন আইসিডিডিআর,বি-র অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট মোহাম্মদ বদরুল আমিন।

ডক্টর ইসলামের ল্যাবের পোস্ট ডক্টরাল গবেষক এবং গবেষণাটির অন্যতম একজন গবেষক প্রভাত তালুকদার বলেন, আমরা দেখেছি যে আর্সেনিক-প্রতিরোধী ই.কোলাইয়ের একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকের, বিশেষ করে তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যা সাধারণত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। আমাদের বর্তমান গবেষণা এই আইসোলেটগুলোর মধ্যে আর্সেনিক এবং অ্যান্টিবায়োটিকের সহ-প্রতিরোধের প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে চলেছে।

টিআই/এসএম