এখন তারা বলছে, বাবা লাস্ট স্টেজে
ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত বকুল মিয়া, চিকিৎসা নিতে এসেছেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে | ছবি- ঢাকা পোস্ট
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ঠিকাদার মো. বকুল মিয়া (৫৫)। তিন বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিআরএইচ)। প্রথম স্টেজেই ছিল। পরবর্তীতে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর এখন তিনি মৃত্যুপথযাত্রী।
বকুল মিয়ার স্বজনদের অভিযোগ, শুরুতে কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও রেডিওথেরাপি দেওয়ার পর শরীরের সর্বত্র ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে। কর্তব্যরত চিকিৎসক বিষয়টি স্বীকার করলেও বলছেন, ‘কোনো ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তি পুরোপুরি সুস্থ হন না।’
বিজ্ঞাপন
বুধবার (১০ মার্চ) সকালে সরেজমিনে এনআইসিআরএইচ ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে। বাবা বকুল মিয়ার পাশে অবস্থান করছিলেন ছেলে ইমরান হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্যান্সার ধরা পড়ার পর বাবাকে নিয়ে প্রতি মাসেই এখানে আসতে হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর এখন চিকিৎসক বলছেন, শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ আমরা যখন ওনাকে প্রথম নিয়ে আসি ওই সময় চিকিৎসক বলেছিলেন, প্রথম স্টেজে আছে। চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তিন বছর চিকিৎসার পর এখন তারা (চিকিৎসক) বলছে, বাবা লাস্ট স্টেজে (শেষ ধাপে) আছে। তাহলে এখানে চিকিৎসা করিয়ে আমাদের কী লাভ হলো?
তিনি একসময় ঠিকাদারি করতেন। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমানো সব টাকা শেষ। এখন জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসা চলছে, তাও শেষপর্যায়ে। এরপর হয়তো ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে হবে। এক রোগীর পেছনে সব শেষ
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর স্বজন
বিজ্ঞাপন
ইমরান হোসেন আরও বলেন, বাবাকে এখন পর্যন্ত ছয়টি কেমোথেরাপি এবং ১২টি রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়েছে। কেমো দেওয়ার পর কিছুদিন সুস্থ বোধ করলেও রেডিওথেরাপির সময় থেকে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকেন।
হাসপাতালে এসে কোনো দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেমোথেরাপির জন্য অসুস্থ বাবাকে নিয়ে সকাল ৮টায় হাসপাতালে আসি। কিন্তু ১১টা পর্যন্ত কেমো দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে ডাক্তার দেখানো, নতুন করে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, সবমিলিয়ে সারাদিনই অসুস্থ বাবাকে নিয়ে এখানে-সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। যা খুবই কঠিন এবং কষ্টকর।’
অসুস্থ বকুল মিয়ার দেখভালের জন্য শুধু ছেলে নন, পাশে অবস্থান করছিলেন মেয়েজামাই রেদোয়ানুল হক। তিনি বলেন, চিকিৎসক জানিয়েছেন, ক্যান্সারের সংক্রমণ রোগীর প্রতিটি হাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় তাকে আর ভালো করা সম্ভব নয়। তবুও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এই রোগীর সংক্রমণ যেহেতু হাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, সেহেতু বলা যায় উনি চতুর্থ স্টেজে আছেন। এ অবস্থায় আসলে ওনার ফিরে আসার সম্ভাবনা কম
কর্তব্যরত চিকিৎসক
‘তিনি একসময় ঠিকাদারি করতেন। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমানো সব টাকা শেষ। এখন জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসা চলছে, তাও শেষপর্যায়ে। এরপর হয়তো ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে হবে। এক রোগীর পেছনে সব শেষ!’
আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, ‘ভাই, সবকিছু বিক্রি করতে রাজি আছি, কিন্তু চিকিৎসক তো কোনো আশা দিতে পারছেন না। প্রথম স্টেজে ছিল। চিকিৎসক বলেছিল, ভালো করা সম্ভব। কিন্তু এখন তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।’
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে বকুল মিয়া এখানে ভর্তি হন। এখন রিপোর্ট বলছে, ক্যান্সার সংক্রমিত হয়ে তার হাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার, প্রধান, এপিডেমিওলজি বিভাগ, এনআইসিআরএইচ
তিনি বলেন, ‘ফুসফুসের ক্যান্সার অত্যন্ত মারাত্মক। প্রাথমিকভাবে এটি শনাক্ত করা বেশ কঠিন। কারণ অন্যান্য ক্যান্সার শনাক্তে যে স্ক্রিনিং পদ্ধতি ব্যবহার হয়, ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্তে সেটি ততটা কার্যকর নয়।’
ফুসফুস থেকে হাড়ে সংক্রমণ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি মানব শরীরের যেকোনো স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে আরও কিছু উপসর্গ দেখা দেবে। যেমন- হাড়ে ছড়িয়ে পড়লে প্রবল ব্যথা অনুভূত হবে। অনেক ক্ষেত্রে ফুসফুস ক্যান্সার মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। লিভারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে পেটে ব্যথা কিংবা জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
‘এই রোগীর সংক্রমণ যেহেতু হাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, সেহেতু বলা যায় উনি চতুর্থ স্টেজে আছেন। এ অবস্থায় আসলে ওনার ফিরে আসার সম্ভাবনা কম’— বলেন দায়িত্বরত ওই চিকিৎসক।
২০১৪ সালে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৯৮৩ জন। মাত্র তিন বছরে এ সংখ্যা প্রায় ২০০ ভাগ বেড়েছে। নারীদের চেয়ে পুরুষদের ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেশি। ২৪.৭ ভাগ পুরুষ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেক্ষেত্রে নারীদের হার মাত্র ৫.২ ভাগ
এ প্রসঙ্গে এনআইসিআরএইচ’র ক্যান্সার এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গ্লোবোকেন-২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ ৫৬ হাজার রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এছাড়াও প্রায় এক লাখ ৯ হাজার মানুষ মারা যান।’
‘অনুমিত ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের এক তৃতীয়াংশ হাসপাতালে ভর্তি হন। বাকি রোগীদের বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। জনগণকে এ রোগ থেকে রক্ষা করতে এবং চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে। যদি প্রথম পর্যায়ে এটি শনাক্ত হয়, তাহলে দ্রুত ওই রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং, ক্যান্সার প্রতিরোধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সরকার আট বিভাগে ৮টি ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।’
ধূমপান ও বায়ু দূষণ বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যান্সার সংক্রমণের প্রধান দুটি কারণ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সরকারকে দূষণ রোধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
৩ বছরে ফুসফুসের ক্যান্সার বেড়েছে প্রায় ২০০ ভাগ
এনআইসিআরএইচ'র রেজিস্ট্রি বিভাগ জানায়, গত তিন বছরে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০০ ভাগ বেড়েছে। ২০১৫ সালের শুরু থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বহির্বিভাগে ৭৬ হাজার ৫৪৩ নতুন রোগী আসেন। পরবর্তীতে তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার ৩৬৯ জনের শরীরে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। এই সময়ে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত মোট পাঁচ হাজার ৮৮৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৯৮৩ জন। মাত্র তিন বছরে এ সংখ্যা প্রায় ২০০ ভাগ বেড়েছে। নারীদের চেয়ে পুরুষদের ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেশি। ২৪.৭ ভাগ পুরুষ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেক্ষেত্রে নারীদের হার মাত্র ৫.২ ভাগ।
এনআইসিআরএইচ'র রেজিস্ট্রি বিভাগ জানায়, এখানে আসার আগে ৭৭.২ ভাগ রোগী ক্যান্সারের কোনো চিকিৎসা পান না। ফুসফুসের ক্যান্সারের পর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নারীদের স্তন ক্যান্সার। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত চার হাজার ৯৯৮ রোগী, দুই হাজার ৭১৯ জন জরায়ু, এক হাজার ৫৮২ জন খাদ্যনালী, এক হাজার ৩৬৬ জন পাকস্থলী, এক হাজার ২২৪ জন লিভার, এক হাজার ১৭৭ জন লিম্ফোমা, এক হাজার ৫৪ জন মলদ্বার, ৮৮৪ জন গাল/ওরাল মিউকোসা এবং ৪৮৫ জন পিত্তথলি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন।
২০১৪ সালের রেজিস্ট্রি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নারী ও পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যান্সারই প্রধান সমস্যা। সেখানে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ২৭.৪ ভাগ নারী মারা গেছেন। জরায়ু ক্যান্সারে মারা গেছেন ১৭.৯ ভাগ নারী।
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ক্যান্সার সংক্রমণে ধূমপান ও বায়ুদূষণকে দায়ী করছেন।
টিআই/এমএআর/