স্মোকিং জোন আছে নামেই, পরিপূর্ণ আইন মানছে না কেউ
হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং ট্রেনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকার বিধান থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তা অকার্যকর। এরফলে ব্যাপকভাবে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন অধূমপায়ীরা। ঢাকা শহরের ১১৮টি আবাসিক হোটেল ও ৩৫৫টি রেস্টুরেন্ট এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ৫৩টি ট্রেনের ওপর পরিচালিত গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে।
রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে), প্রজ্ঞা এবং ভয়েস আয়োজিত ‘বিল্ডিং এ টোব্যাকো ফ্রি বাংলাদেশ- লোকাল অ্যান্ড গ্লোবাল এভিডেন্স শেয়ারিং’ অনুষ্ঠানে এই গবেষণা তুলে ধরা হয়।
বিজ্ঞাপন
জনস্ হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ এবং গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) যৌথভাবে “প্রিভেলেন্স অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স অব ডেজিগনেটেড স্মোকিং এরিয়াস (ডিএসএ) ইন হসপিটালিটি ভেন্যুস অ্যান্ড ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা, বাংলাদেশ” শীর্ষক এই গবেষণা পরিচালনা করেছে।
জানা গেছে, মোট ৫২৬টি গবেষিত ভেন্যুর মধ্যে মাত্র ৪১টিতে (৮%) ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা বা ডেজিগনেটেড স্মোকিং এরিয়া (ডিএসএ)’ পাওয়া গেছে, যার একটিতেও পরিপূর্ণভাবে আইন মেনে ডিএসএ রাখা হয়নি।
উপস্থাপনায় বলা হয়, ১১৮টি আবাসিক হোটেলের মধ্যে মাত্র ১৮টিতে ডিএসএ পাওয়া গেছে। ৭টি হোটেলের ডিএসএ ধূমপানমুক্ত এলাকা থেকে আলাদা নয় এবং ৭টিতে সেবা দেওয়ার জন্য কর্মীদের ডিএসএ অতিক্রম করতে হয়। তবে, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকাকে (ডিএসএ) ধূমপানমুক্ত এলাকা থেকে পৃথক রাখার বিধান রয়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও ১৭টি হোটেলের ডিএসএ’তে সতর্কতামূলক নোটিশ প্রদর্শন করা হয়নি।
বিজ্ঞাপন
গবেষণায় ৫৩টি ট্রেনের ২১টিতে ডিএসএ পাওয়া গেছে, যারমধ্যে ৭টিতে বিভিন্ন খাবার ও পানীয় বিক্রি হওয়ায় অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ডিএসএ থাকা ২১টি ট্রেনের কোনোটিতেই ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা বা ডিএসএ সংক্রান্ত কোনো নোটিশ দেখা যায়নি। অর্থাৎ ১টি ট্রেনেও পরিপূর্ণভাবে আইন মেনে ডিএসএ রাখা হয়নি। ৩৫৫টি রেস্টুরেন্ট এর মধ্যে মাত্র ২টিতে ডিএসএ পাওয়া গেছে এবং কোনটিতেই এ সংক্রান্ত আইন পরিপূর্ণভাবে মানা হয়নি।
প্রজ্ঞার গবেষণায় বলা হয়েছে, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা (ডিএসএ) অধূমপায়ীদের পরোক্ষ ধূমপানের ছোবল থেকে সুরক্ষা দিতে পারে না এবং এই বিধান চালু রেখে ধূমপানমুক্ত আইন বা নীতির সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে ডিএসএ বাতিল করা প্রয়োজন।
ভয়েসের উপস্থাপনায় জানানো হয়, তামাক কোম্পানিগুলো নগদ টাকা ও সরঞ্জামাদি দেওয়ার মাধ্যমে রেস্টুরেন্টগুলোতে ডিএসএ স্থাপনে উৎসাহিত করে থাকে। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণেই কোম্পানিগুলো এই কূটকৌশল অবলম্বনের সুযোগ পাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্বস্বাস্থ্য অনুবিভাগ) কাজী জেবুন্নেছা বেগম। এসময় তিনি বলেন, আশাকরি ডিএসএ বাতিলসহ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী দ্রুত পাস হবে এবং সেটা হলেই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের পথ সুগম হবে।
সিটিএফকের প্রিন্সিপাল কনসালটেন্ট, সাউথ এশিয়া কমিউনিকেশনস জসপ্রীত কাউর পাল বলেন, পরিপূর্ণভাবে আইন প্রতিপালন করে এমন একটিও ডিএসএ গবেষণায় পাওয়া যায়নি। কাজেই ধূমপানমুক্ত স্থানে ডিএসএ বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। পরোক্ষ ধূমপান থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশ্বের ৬৭টি দেশের ন্যায় বাংলাদেশকেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে ডিএসএ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে হবে।
এসময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে চাইলে ডিএসএ বিধান অবশ্যই বাতিল করতে হবে। এটি তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনের অন্তরায়।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী (অতিরিক্ত সচিব) হোসেন আলী খোন্দকার, সিটিএফকে বাংলদেশ লিড পলিসি অ্যাডভাইজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা।
গ্লোব্যাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, বাংলাদেশে আচ্ছাদিত কর্মস্থলে কাজ করেন এমন প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৪২.৭ শতাংশ (৮১ লাখ) এবং প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (২৪ শতাংশ) গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রায় ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে থাইল্যান্ড, নেপাল, তুরস্কসহ বিশ্বের ৬৭টি দেশ পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত আইন প্রণয়ন (‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার বিধান বাতিলসহ) ও বাস্তবায়ন করছে।
টিআই/এসএম