মশা নয় পোড়া বস্তিতে যেন ‘ভিমরুলে’র উপদ্রব!
২ সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মশার উপদ্রব বেড়েছে। বস্তি এলাকায় এই উপদ্রব ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সেখানে রীতিমতো ভিমরুলের মতো মশার ‘চাক’ ঘুরছে। বাসিন্দারা বলছেন সিটি করপোরেশন ঠিকমতো মশার ওষুধ দিচ্ছে না, ফগার মেশিনের ধোঁয়াও দিচ্ছে না।
রাজধানীর কল্যাণপুর পোড়া বস্তির বাসিন্দা ফাতেমা বেগম। বস্তিতে মশার উপদ্রব নিয়ে খুবই বিরক্ত এ নারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বস্তিতে অনেক মশা, দিনেও ঘুমানো যায় না মশারি ছাড়া।
বিজ্ঞাপন
বোনের বাচ্চার শরীর দেখিয়ে ফাতেমা বেগম বলেন, দেহেন বাচ্চাডার শরীর গোটা গোটা হয়ে গেছে। কয়েল, ধোঁয়া কোনো কিছুতে কাজ হচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে ধোঁয়া দেওয়ার লোক আসে, তাতে কোনো কাজ হয় বলে মনে হয় না।
পোড়া বস্তির ঘরে ঘরে একই অভিযোগ, মশা বেড়ে গেছে...।
বিজ্ঞাপন
কল্যাণপুর পোড়া বস্তি ঘুরে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি সেখানে মশার উপদ্রব বহুগুণ বেড়ে গেছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তা নেওয়া হচ্ছে না। ময়লা জমে থাকছে যেখানে সেখানে। বস্তি-ঘেঁষা লেক ও পুকুরের পানিতে মশার বংশবিস্তার ঘটছে।
বস্তিতে মশাবাহিত রোগ নিয়ে যেমন শঙ্কা বেড়েছে তেমনি প্রশ্ন উঠেছে মশা নিধন কার্যক্রম নিয়েও। বস্তিবাসীর অভিযোগ, মাসে ২/৩ বারের বেশি দেওয়া হয় না মশার ওষুধ বা ফগার মেশিনের ধোঁয়া।
পোড়া বস্তির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, মানুষের বসবাস ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে। সব ঘর পাশাপাশি। অনেকগুলো ঘরের মাঝে চলাচলের জন্য সরু গলি পথ। বস্তির পেছনে বিশাল পুকুর। মশার বিস্তারক্ষেত্র হয়ে উঠেছে পুকুরটি। পুকুর ঘেঁষে এক বাসিন্দার ঘর থেকে আসছিল কান্নার আওয়াজ। কাছে গিয়ে দেখা যায়, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ এক বাচ্চা কাঁদছে। তার মা দ্রুত মশারি খাটিয়ে বাচ্চাকে শুইয়ে দিচ্ছেন।
বাইরে চুলা জ্বালিয়ে রান্না করতে করতে ওই বাচ্চার মা নিলা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চারদিকে মশা আর মশা। মশার জন্য বসাই যায় না। কয়েলেও মশা যায় না। ছয় মাসের বাচ্চাকে নিয়ে খুব বিপদে আছি।
বস্তির শেষ মাথায় পুকুর ঘেঁষে একটি ঘরে স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকে আসা আব্দুল করিম। তিনি বলেন, সন্ধ্যায় মশা তাড়াতে কয়েল জ্বালালেও কাজ হয় না। সিটি করপোরেশন ওষুধ দেয় খুবই কম। ধোঁয়া দিতে দেখাই যায় না। এই যে দেখেন ডোবা, পুরো ডোবা ময়লায় ভর্তি, সঙ্গে দুর্গন্ধ তো আছেই। এখানেই মশার জন্ম হয়।
তিনি বলেন, ১৩ বছর ধরে এই বস্তিতে আছি। এত মশা আগে দেখিনি। বস্তিবাসীর অবস্থা খুব খারাপ। দুই মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। তাই বউ-বাচ্চা গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি।
মশা নিধনের গাড়ি, ওষুধ নিয়ে কেউ আসে কি না জানতে চাইলে বস্তির বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী ফাতেমা বেগম বলেন, আহে, এক মাস বাদে বাদে আহে। পুরো বস্তি নোংরা, পানি জমে থাকে। থাকি তো বস্তিতে, করার তো কিছু নাই, দেখারও কেউ নাই।
ওজুল্লা নামে এক বাসিন্দার ১০ বছরের ছেলে রাকিব জানায়, বস্তিতে সবসময়ই মশা থাকে। রাতে মশা বেড়ে যায়। পুস্কুনিতে (পুকুর) ওষুধ দিতে দেখছি কিন্তু মশা তাড়ানোর ধোঁয়া দিতে দেখি নাই। ময়লা নিতেও আসে না লোক।
পান্না বেগম নামে এক নারী বলেন, প্রচুর মশা, বিদ্যুৎ গেলে ঘরের বাইরে আইসা যে কোথাও বমু (বসব) সে অবস্থা নাই। মশা কামড়ায়, চুলকায়, বাচ্চাদের শরীল দাগ হয়ে যায়। গত ক’দিন তো বাচ্চা জ্বরে ভুগল। ডাক্তার কইছে মশা তাড়াইতে, সবসময় মশারিতে থাকতে।
৩০ বছর ধরে পোড়া বস্তিতে থাকা জাহানারা বেগম বলেন, এবার অতিরিক্ত মশা, একেবারে ভিমরুলের মতো মশা গিজগিজ করতাছে। এত মশা আগে দেখি নাই। মশার ওষুধ বলতে মাঝে-মধ্যে রাস্তার ধারে ধোঁয়া দিয়া যায়। বস্তির ভেতরে আসে না, ঘরেও ঢোকে না।
একই অবস্থা গুলশান কড়াইল বস্তির
এদিকে গুলশান কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা জানান, সেখানেও মশার উপদ্রব বেড়েছে। আগের মতো মশা তাড়ানোর ধোঁয়া দিতে দেখা যায় না।
বস্তিতে ব্যবসা করা শাকিল নামে এক বাসিন্দা বলেন, মশা কোনোভাবেই কমছে না, মশা মারার লোক এ বছর দেখিনি।
কোহিনুর বেগম নামে এক নারী বাসিন্দা বলেন, মশার উৎপাত বেশি। লেকের পানির দিকে তাকানো যায় না। ময়লা প্রচুর। কয়েকদিন আগে বয়স্ক এক বাসিন্দা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলো। অনেকেই জ্বরে ভুগছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।
সেলুনের কর্মী হুমায়ুন বলেন, ওষুধে কাম হয় না, কয়েলেও মশা যায় না। আমি বউ বাজারের দিকে থাকি। মশা সব জায়গাতেই বেশি।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পোড়া বস্তিতে প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসবাস। ইদানীং ঘর আরও বাড়ছে বস্তিতে। কেউ কেউ মাচান দিয়ে ঘর তুলছেন। সেখানে মশার ওষুধ ছিটানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এই বস্তির সঙ্গেই একটি বড় পুকুর থাকায় আমরা কেমিফস্ট দিয়ে মশা মারতাম। নৌকা এনে আমরা পুকুরের পাড় ঘেঁষে, সুয়ারেজ লাইনে ম্যালেরিয়া ওয়েলবি দিচ্ছি।
তিনি স্বীকার করে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে বস্তিতে মশার উপদ্রব বেশি, এটা ঠিক। আমাদের লোকজন কাজ করছে। মশা কমতে শুরু করেছে। আশা করছি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বস্তির মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
ডিএনসিসি’র ২০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফগার মেশিনের ধোঁয়ায় মশা নড়েও না। আমরা এখন মশার লার্ভা ধ্বংসে মনোযোগ দিয়েছি। বসতির পাশে লেকের পানিতে এবং ড্রেনে ময়লা জমা পানিতে ওষুধ দিচ্ছি। সামনে মশারি বিতরণ করা হবে।
ডিএনসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মশার উপদ্রব ঠেকাতে জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন। আমরা সেটা আন্তরিকভাবে করছি। মশা তাড়ানো ছাড়াও মশার জন্ম ও বংশবিস্তার রোধে নিয়মিত কিছু কাজ হচ্ছে যা আরও বেগবান করা হবে। যাদের নিয়ন্ত্রণে পুকুর ও জলাশয় রয়েছে তারা পরিষ্কার না করলে মামলা দিচ্ছি।
তিনি বলেন, বস্তিতে মশার উপদ্রব বাড়ার মূল কারণ ময়লা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। সেদিকে বিশেষ নজর রেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
জেইউ/জেডএস