২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে মোট অগ্নিকাণ্ড, অগ্নিকাণ্ডের কারণ এবং সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ

প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। আগুনের ভয়াবহতায় সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আর্থিক ক্ষতি ছাপিয়ে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। যদিও মূল আলোচনা রয়ে যাচ্ছে আড়ালে। গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, অধিকাংশ আগুনের বড় কারণ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। নিম্নমানের তার ব্যবহারে এটি হয়ে থাকে।

ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ৯৯ হাজার ৭৫২টি। সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ১৪৬০ কোটি ৫২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৯১ টাকা। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের ঘটনা ৩৭ হাজার ৪০৪টি, যা মোট আগুনের ৩৭.৯২০ শতাংশ। ক্ষতির পরিমাণ ৮৩৪ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার ৩৫০ টাকা, যা মোট ক্ষতির ৫৭.১২ শতাংশ। অন্যান্য কারণে সম্পদের মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬২৬ কোটি ১৮ লাখ ১৩ হাজার ৬৪১ টাকা।

ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীসহ সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ। বহুতল বাণিজ্যিক ভবন কিংবা আবাসিক ভবনে নকল ইলেকট্রিক ক্যাবল (বৈদ্যুতিক তার) বা মানহীন তার ব্যবহারই এর অন্যতম কারণ।  কখনও কখনও ওভার লোডের কারণেও আগুনের সূত্রপাত ঘটে।

বাজারে আসলের চেয়ে নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবলের (তার) ছড়াছড়ি। দেশের প্রতিষ্ঠিত ও ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানগুলোর তাগিদ সত্ত্বেও নকল ক্যাবল উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ। আগুনের জন্য শুধু শর্ট সার্কিট দায়ী নয়, সার্কিট ব্রেকারও দায়ী। বহুতল বাণিজ্যিক ভবন কিংবা আবাসিক ভবনে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুণগতমানের ইলেকট্রিক ক্যাবল (বৈদ্যুতিক তার) ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা দেখার কেউ নেই

ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর বলছে, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি নির্দেশনা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন বৈদ্যুতিক ক্যাবল ব্যবহারে মানুষের রয়েছে অনীহা। যে কারণে শর্ট সার্কিট থেকে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটছে। পুড়ে যাচ্ছে বিলাসবহুল ভবন, ছারখার হচ্ছে একের পর এক বস্তি, দোকানপাট, মার্কেট। বিপন্ন হচ্ছে জনজীবন।

গত ১৪ মার্চ বেলা ১২টা ২৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর খিলক্ষেতের কনকর্ড লেকসিটি এলাকার একটি ১৬তলা ভবনের পঞ্চম তলায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট। আধাঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সর্বশেষ গতকাল বুধবার (১৭ মার্চ) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য বরাদ্দ আইসিইউ ইউনিটে আগুন লাগে। ওই ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়। তবে কেউ আগুনে পুড়ে মারা যাননি।

ঢামেকে আগুনের ওই ঘটনায় প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক। অভিযোগ আছে, অগ্নিকাণ্ডের সময় রোগীদের উদ্ধারে নার্স-ওয়ার্ড বয় কেউ এগিয়ে আসেননি। স্বজনরাই কাঁধে তুলে রোগীদের বাইরে বের করে আনেন।

২০২০ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২১ হাজার ৭৩টি। এসব আগুনে সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ৪৪ টাকা। অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। এ কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সাত ৭২৯টি। যা মোট অগ্নিকাণ্ডের ৩৬.৬৮ শতাংশ। এতে ক্ষতি হয়েছে ১০১ কোটি ২৩ লাখ ৯৩ হাজার ১০৮ টাকার সম্পদ

এছাড়া বনানীর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এফআর টাওয়ারের (ফারুক রূপায়ণ টাওয়ার) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখনও মানুষের মনে দাগ কাটে। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চের ওই দুর্ঘটনায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত ৭০ জন। ওই ঘটনার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অষ্টম তলার শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরবর্তীতে তা উপরের নবম ও দশম তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ধোঁয়ার কারণে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে আসলের চেয়ে নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবলের (তার) ছড়াছড়ি। দেশের প্রতিষ্ঠিত ও ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানগুলোর তাগিদ সত্ত্বেও নকল ক্যাবল উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ। আগুনের জন্য শুধু শর্ট সার্কিট দায়ী নয়, সার্কিট ব্রেকারও দায়ী। বহুতল বাণিজ্যিক ভবন কিংবা আবাসিক ভবনে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুণগতমানের ইলেকট্রিক ক্যাবল (বৈদ্যুতিক তার) ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা দেখার কেউ নেই।

বাজারে ভেজাল বৈদ্যুতিক ক্যাবল সহজলভ্য। সার্কিট ব্রেকার পর্যন্ত আপনি নকল ও মানহীন পাবেন। আর গ্রাহক বা ভোক্তার মধ্যে মানসম্পন্ন পণ্য কেনার চাইতে কম টাকায় এসি, ফ্রিজ, বৈদ্যুতিক তার কেনায় আগ্রহ বেশি। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ

লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান, পরিচালক, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স

ফায়ার সার্ভিস সদরদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২১ হাজার ৭৩টি। এসব আগুনে সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ৪৪ টাকা। অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। এ কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সাত ৭২৯টি। যা মোট অগ্নিকাণ্ডের ৩৬.৬৮ শতাংশ। এতে ক্ষতি হয়েছে ১০১ কোটি ২৩ লাখ ৯৩ হাজার ১০৮ টাকার সম্পদ।

২০১৯ সালের ক্ষতির চিত্র

এ বছর মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ২৪ হাজার ৭৪টি। ক্ষতি হয় ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ ২৮ হাজার ৭৪৪ টাকার সম্পদের। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুনের ঘটনা আট হাজার ৬৪৪টি। যা মোট আগুনের ৩৯ শতাংশ। ক্ষতি ২৩২ কোটি ৩৯ লাখ ৪৫ হাজার ৮১৬ টাকার সম্পদের।

২০১৮ সালের ক্ষতির চিত্র

এ বছর মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ১৯ হাজার ৬৪২টি। সম্পদের ক্ষতি ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৫ টাকার। সবচেয়ে বেশি সাত হাজার ৮২৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে। যা মোট অগ্নিকাণ্ডের ৩৮ শতাংশ। এতে মোট ২০৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৩৭৫ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়।

২০১৭ সালের ক্ষতির চিত্র

এ বছর মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৮ হাজার ১০৫টি। সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ২৫৭ কোটি ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮৬ টাকার। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের ঘটনা ছয় হাজার ৬৯০টি। যা মোট আগুনের ৩৬.৯৫ শতাংশ। শর্ট সার্কিটের আগুনে ক্ষতি হয় ১৩৭ কোটি ২ লাখ ৭০ হাজার ৩৪১ টাকার সম্পদের।

২০১৬ সালের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতি

মোট ঘটনা ১৬ হাজার ৮৫৮টি। ক্ষতির পরিমাণ ২৪০ কোটি ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ৮২২ টাকার সম্পদের। শুধু বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের ঘটনা ছয় হাজার ৫১৬টি। যা মোট আগুনের ৩৯ শতাংশ। সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ১৫৯ কোটি ২৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭১০ টাকার।

বনানীর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন এফআর টাওয়ারে লাগা আগুন নেভাতে ব্যবহার হয় হেলিকপ্টার

খোদ রাজধানীতে নকল বৈদ্যুতিক তারের ছড়াছড়ি

খোদ রাজধানীতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পণ্য নকল করা হচ্ছে। রাজধানীর বংশাল, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার এলাকায় নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানার সন্ধান মিলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের লোগো হুবহু নকল করে সেসব পণ্য রাজধানীসহ সারাদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে।

ভোল্টেজের তারতম্য হলেই মানহীন বৈদ্যুতিক তার বহুতল ভবনে অগ্নিঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ভালো মানের তার সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত লোড নিতে পারে। যদি লোড বেশি হয় তাহলে স্পার্ক হতে পারে। স্পার্ক হয়ে তার গরম হলে আগুনের ঝুঁকিও বাড়ে

অধ্যাপক আনিস আহমেদ, চেয়ারম্যান, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাবি

বিগত কয়েক বছরে ভয়াবহ সব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত টাস্কফোর্স ও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও উঠে আসে আগুন লাগার বড় কারণ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের কথা। এরপর আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক ডিজাইনের পাশাপাশি গুণগত ও মানসম্পন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সতর্কতা জারি করে ফায়ার সার্ভিস। এরপরও বাজারে আসলের চেয়ে নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির ছড়াছড়ি।

সম্প্রতি রাজধানীর একাধিক স্থানে পুলিশের এলিট ফোর্স- র‌্যাব পরিচালিত একাধিক অভিযানে বিআরবি, পলিক্যাবল, প্যারাডাইস, ইস্টার্ন ক্যাবল, বিবিএসসহ নামিদামি ব্র্যান্ড ও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির পণ্য পাওয়া যায় কিছু বেনামি কারখানায়। গত ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর ওয়ারীতে র‌্যাব-১০ এর সদস্যরা অভিযান চালান। অভিযানে অনুমোদনহীন নকল বৈদ্যুতিক তার, নিম্নমানের বয়লার উৎপাদন, মজুত ও বিক্রির অভিযোগে তিন প্রতিষ্ঠান সিলগালাসহ সাত প্রতিষ্ঠানকে ২২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্দেশে ৫২ লাখ টাকা মূল্যের নকল বৈদ্যুতিক তার, ৫৫০ পিস ভালভ ও ১২১ পিস বয়লার জব্দ করা হয়।

নবাবপুরে র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হওয়া নকল ক্যাবল 

অনুমোদনহীন, ভেজাল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন, বিক্রি ও বাজারজাত করায় গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর কদমতলীতে পরিচালিত অভিযানে চার প্রতিষ্ঠানের পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২৪ লাখ টাকা জরিমানা করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সারাদেশে আমাদের ৮৬ কর্মকর্তা রয়েছেন যারা নিয়মিত বৈদ্যুতিক পণ্যের মান পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ এবং কারখানা পরিদর্শন করেন। আমাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে বিএসটিআই বৈদ্যুতিক পণ্যের মান নিশ্চিতে নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদন এবং তা বাজারজাত বন্ধে বদ্ধপরিকর

মো. সাজ্জাদুল বারী, পরিচালক (সার্টিফিকেশন মার্কস উইং), বিএসটিআই

এছাড়া গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর একই অভিযোগে রাজধানীর বংশাল থানার নবাবপুর জাকির হোসেন মার্কেটে দিনভর অভিযান চালায় র‌্যাব। ছয়টি ভুয়া প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড, ৪০ লাখ টাকা জরিমানা এবং প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের নকল তার জব্দ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

র‌্যাব জানায়, অনুমোদনহীন এসব কারখানায় বিআরবি, বিজলী ক্যাবলস, প্যারাডাইস ক্যাবলস, ইস্টার্ন ক্যাবলস, পলি ক্যাবলস, বিবিএস ক্যাবলসের নামে নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন হচ্ছিল। পরে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র‌্যাব সদরদফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অসাধু ব্যবসায়ীরা অনুমোদনহীন নকল বৈদ্যুতিক তার, নিম্নমানের বয়লার উৎপাদন, মজুত ও বিক্রি করে আসছিল। আসল ও ব্র্যান্ডের পণ্য মনে করে এসব ভেজাল, মানহীন ও অনুমোদনহীন বৈদ্যুতিক তার কিনে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা তেমনি ব্র্যান্ডের কোম্পানির পণ্য নিয়েও তৈরি হচ্ছে সন্দেহ। এসব নকল বৈদ্যুতিক তার ব্যবহারে শর্ট সার্কিটসহ বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশি থাকছে।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভবনে, মার্কেটে, বস্তিতে আগুন লাগার জন্য একটি স্পার্কই (স্ফুলিঙ্গ) যথেষ্ট। বদ্ধ ঘরে যদি গ্যাসের লাইনে লিক থাকে এবং সেখানে জমে থাকা গ্যাসের মধ্যে যদি বৈদ্যুতিক সুইচ দিতে গিয়ে স্পার্ক হয় তাহলে আগুন লেগে যাবে। এখানে বৈদ্যুতিক তার বা সুইচ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মান নিশ্চিত করতে হবে।’

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স

তিনি বলেন, বাজারে ভেজাল বৈদ্যুতিক ক্যাবল সহজলভ্য। সার্কিট ব্রেকার পর্যন্ত আপনি নকল ও মানহীন পাবেন। আর গ্রাহক বা ভোক্তার মধ্যে মানসম্পন্ন পণ্য কেনার চাইতে কম টাকায় এসি, ফ্রিজ, বৈদ্যুতিক তার কেনায় আগ্রহ বেশি। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

‘ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত ডিজাইনের পাশাপাশি ইলেকট্রিক ডিজাইনটাও নিয়ম মেনে করা উচিত। যেটা অনেকেই করতে চান না। নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিজেরই সতর্ক থাকতে হবে। এরপর অন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়। নিজেকে নিশ্চিত করতে হবে বেস্ট (ভালো) পণ্যটা ক্রয় করা এবং ভবনে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের মান নিশ্চিত করা। লোড অনুযায়ী তারের ব্যবহারও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনিস আহমেদ এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মানহীন বৈদ্যুতিক তার ব্যবহারে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে। ঝুঁকি সত্ত্বেও অনেক বেশি অনৈতিক এ কাজটি হচ্ছে। ভোল্টেজের তারতম্য হলেই মানহীন বৈদ্যুতিক তার বহুতল ভবনে অগ্নিঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ভালো মানের তার সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত লোড নিতে পারে। যদি লোড বেশি হয় তাহলে স্পার্ক হতে পারে। স্পার্ক হয়ে তার গরম হলে আগুনের ঝুঁকিও বাড়ে।’

‘আবার শর্ট সার্কিটের ক্ষেত্রে শুধু মানহীন তার দায়ী নয়, সার্কিট ব্রেকারও বেশ দায়ী। দুঃখজনক হলেও মানহীন সার্কিট ব্রেকার বাজারে আছে। পুরাতন অবকাঠামোগুলোতে এমন ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপাপ্ত কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি।’

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরিচালক (সার্টিফিকেশন মার্কস উইং) মো. সাজ্জাদুল বারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করি। ১৮৬টি পণ্য এক্ষেত্রে অনুমোদিত। এর মধ্যে অধিক প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) পায় ২৭টি পণ্য। তবে বাজারে অনেক বৈদ্যুতিক পণ্য রয়েছে। 

‘সারাদেশে আমাদের ৮৬ কর্মকর্তা রয়েছেন যারা নিয়মিত বৈদ্যুতিক পণ্যের মান পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ এবং কারখানা পরিদর্শন করেন। আমাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে বিএসটিআই বৈদ্যুতিক পণ্যের মান নিশ্চিতে নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদন এবং তা বাজারজাত বন্ধে বদ্ধপরিকর।’

জেইউ/এমএআর/