দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যুর এক বছর আজ
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর এক বছর হলো আজ (১৮ মার্চ)। এর আগে গত ৮ মার্চ (সোমবার) দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার এক বছর পূর্ণ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) পর্যন্ত ভাইরাসটিতে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩৯ জনে। একইসঙ্গে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল আট হাজার ৬২৪ জনে। তবে, এখন পর্যন্ত ভাইরাসটি থেকে মুক্ত হয়েছেন পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৫২৩ জন।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছিল গত বছরের ৮ মার্চ, আর প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল তার ঠিক ১০ দিন পর, ১৮ মার্চ।
এর আগে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্য প্রকাশ করা হয় এবং ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের কথা ঘোষণা করে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের গত এক বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে একমাত্র আইইডিসিআর ছাড়া করোনা পরীক্ষার জন্য আর কোথাও আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরি ছিল না। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২১৯ ল্যাবরেটরিতে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১১৮টি, জিন-এক্সপার্ট ২৯টি, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৭২টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪৩ লাখ ২৮ হাজার ২৬৯টি।
বিজ্ঞাপন
গেল বছর ৮ মার্চ প্রথম করোনা সংক্রমণের তিন মাস পর ১৮ জুন তা ১ লাখ ছাড়ায়। ঠিক এক মাসেই রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ২ লাখে দাঁড়ায়। তিন লাখ ছাড়ায় পরের মাসের ২৬ তারিখ, তৃতীয় এক লাখ রোগী শনাক্ত হয় এক মাস নয় দিনে। এরপর থেকে শনাক্ত কিছুটা কমে। চতুর্থ এক লাখ রোগী শনাক্ত হয় দুই মাসে। ২৬ অক্টোবর রোগীর সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে যায়। আর গত ২০ ডিসেম্বর রোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়ায়। এরপরের ৭৭ দিনে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ল আরও অর্ধলাখ।
এর মধ্যে গেল বছর ২ জুলাই দেশে একদিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়। সেদিন ৪ হাজার ১৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
দ্রুত সময়েই আবার স্বাভাবিক পরিবেশে দেশ
সবকিছু ছাপিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্ব এবং নির্দেশনায় দ্রুত সময়ের মধ্যেই দেশ আবার স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি দেশে করোনাভাইরাসের টিকাও এসেছে। ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ওই টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে এরই মধ্যে সাফল্যের কৃতিত্ব দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছে জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আরও একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা।
আবারও বাড়ছে সংক্রমণ
করোনাভাইরাসে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু উভয়ই বেড়ে চলেছে। নতুন করে আক্রান্ত হওয়াদের অধিকাংশই তরুণ এবং অনেকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সাপোর্ট প্রয়োজন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণরা যে শুধু আক্রান্তই হচ্ছেন তা নয়, বরং বেপরোয়া চলাফেরা করে অন্যদের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন।
সরকারি সংস্থা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, দেশে করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের ৫০ শতাংশেরই বয়স ২১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, সারাবিশ্বেই তরুণদের আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, সাউথ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়া ও টেক্সাসসহ আরও কিছু অঙ্গরাজ্যে তরুণদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের বেশি হারে আক্রান্ত হওয়াকে এখন বিশ্বব্যাপী বিশেষ উদ্বেগের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ প্রধানত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়। কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস ছাড়ার সময় বা হাঁচি-কাশির সময় অসংখ্য ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাসটি কিছুক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকে। এটি একটি আরএনএ ভাইরাস, এর চারপাশে থাকে লিপিডের (এক ধরনের চর্বি) আবরণ ও কাঁটার মতো স্পাইক গ্লাইকো প্রোটিন। অন্যদিকে, মানুষের কোনো কোনো কোষে থাকে এইস-২ রিসেপ্টর (গ্রাহক-কোষ)। দেহকোষে এই রিসেপ্টরের ঘনত্ব বেশি থাকলে আক্রান্ত হওয়ার বিপদ বেশি, কম থাকলে বিপদও কম।’
শাহানা বানু বলেন, ‘সম্প্রতি স্বাস্থ্য মহাপরিচালকও বলেছেন, নতুন করে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই তরুণ। এতোটাই দ্রুত তাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে, ফলে আইসিইউতে নিতে হচ্ছে। এজন্য গত কয়েকদিনে সংক্রমণের পাশাপাশি মৃত্যুর হার বেশি।’
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, যে কোনো সংক্রামক ব্যাধি এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে। তার জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী পদক্ষেপগুলো জোর দিয়ে অনুসরণ করতে হবে। বিশেষ করে বন্দরগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা, সংক্রমণ নিয়ে আসতে পারে এমন লোকদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা এবং স্থল, নৌ, বিমানবন্দরগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। দেশের ভেতরে যদি সংক্রমণ হয়, সেটা শনাক্তকরণের ব্যবস্থা রাখা, সেগুলোর সার্ভিলেন্সের ব্যবস্থা রাখা, এগুলো জোর দিয়ে করতে হবে।
সংক্রমণ নিয়ে যা বলছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশে আপাতত লকডাউনের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে আমরা সব করতে পারব। করোনা সংক্রমণ বাড়বে না।
বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, করোনা থেকে বাঁচা ও চিকিৎসার উপায় আমরা জানি। কিন্তু সব জেনেও আমরা মানি না। করোনা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অর্থনীতি থাকবে না। সমস্যা সৃষ্টি হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
তিনি বলেন, দেশ থেকে করোনা চলে যায়নি, নো মাস্ক নো সার্ভিস পলিসি মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।
জাহিদ মালেক বলেন, করোনার এ সময়ে সারা দেশব্যাপী সামাজিক দূরত্ব ও মাস্কপরা নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মানলে সংক্রমণ রোধ করা যায়, তা জানা থাকলেও মানুষ অসচেতনভাবে চলাফেরা করছেন। আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে চাইলে বিয়েসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান না করার অনুরোধ জানান তিনি।
টিআই/এসএম/এমএমজে