ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক

দুর্বল শরীরটা পরে আছে হাসপাতালের বিছানায়। বাম পা বিছানার সঙ্গে বাঁধা। হাতে স্যালাইনের সুই। আছে অপারেশনের খরচ যোগানোর চিন্তা। 

৯২ বছর বয়সে এমন চিন্তায় পড়তে হবে ভাবেননি ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। এই চিন্তায় পড়তে হলো- কারণ, প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি যে একাকী জীবন কাটাচ্ছেন, রাষ্ট্র হয়ত তা ভুলে গেছে। তার পরিবার বলতে তিনি যে একাই, ভুলে গেছে এটাও। 

শনিবার (২০ মার্চ) বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর গ্রিন রোডে গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে দেশের অন্যতম প্রাবন্ধিক ও ভাষাসৈনিক আহমদ রফিককে দেখা গেল এভাবেই। বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে হঠাৎ পড়ে গিয়ে মাথা ও কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা পান তিনি। ভোর সাড়ে তিনটার দিকে তার ভক্ত সাইফুজ্জামান সাকন ও রাসেল তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রফেসর খন্দকার আবদুল আওয়াল রিজভী ঢাকা পোস্টকে জানান, বাম উরুসন্ধির হাড় ভেঙে গেছে ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিকের। যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করতে হবে।

হাসপাতালে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

অপারেশনের জন্যে আহমদ রফিকের নিকটাত্মীয় খোঁজ করলে কাউকে পাওয়া যায়নি। কয়েকজন তরুণ শুভাকাঙ্ক্ষীর বাইরে তার পাশে দেখা যায়নি কাউকে।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের গাড়ি চালক হিসেবে সঙ্গে আছেন মো. আবুল কালাম। দেড় দশক ধরে তিনিই দেখাশোনা করেন আহমদ রফিককে।

আলাপকালে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ২০০৬ সালে স্যারের স্ত্রী মারা যাওয়ার পরেই স্যার একা হয়ে যান। তার কোনো সন্তান না থাকায় দেখার আর কেউ থাকে না। তিনি তো পরিবারের সবার ছোট, সেভাবে কেউ নেই তাঁর খোঁজ-খবর নেওয়ার। ভাগ্নি, ভাতিজী, ভাতিজা এবং দূর সম্পর্কের শ্যালিকা একজন আছেন। তারা মাঝেমধ্যে খোঁজ-খবর নেন। তাদের অনেকেই আবার দেশের বাইরে থাকেন। সব মিলিয়ে স্যার এখন নিঃসঙ্গ।

সরকারের পক্ষ থেকে কোনো খোঁজ-খবর নেওয়া হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না। কখনও এমনটা দেখি নাই। উনি লিখে যা আয় করেন তা দিয়েই বাসা ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চলে। এছাড়া কিছু পুরস্কারের অর্থ হয়তো জমানো আছে, সেখান থেকেও খরচ করেন। খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন স্যার (আহমদ রফিক)। নিরহংকারী সাদামাটা জীবন যাপন করতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। চিকিৎসার জন্য খুব বেশি খরচ করতে হলে তা উনার জন্যে কঠিন হবে।

২০১৭ সাল থেকে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের সঙ্গে আন্তরিকতা সাইফুজ্জামান সাকনের। ওই সময়ের পর থেকে প্রায় নিয়মিতই যান আহমদ রফিকের বাড়িতে। খোঁজ-খবর নেওয়াসহ লেখা নিয়ে নানা গল্প করেন সাইফুজ্জামান সাকন। তিনি বলেন, স্যার (আহমদ রফিক) নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খান। হয়তো বাথরুমে যেতে বা খাট থেকে নামার সময়ে পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন। ১৯ মার্চ রাত দেড়টার দিকে ঘটনাটি ঘটে। তার একটু পরেই স্যারের বাড়ির কাজের বুয়ার ফোন পাই। 

সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে প্রফেসর খন্দকার আবদুল আওয়াল রিজভী বলেন, ওনার (আহমদ রফিক) বয়স ৯২ বছর চলছে। শারীরিক অবস্থা খুব বেশি ভালো না। ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, হার্টের অপারেশনসহ বেশ কিছু জটিল সমস্যা রয়েছে। ফলে তার জন্য কোমরের অপারেশন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তবে মাথার আঘাত শিগগিরই সেরে যাবে।

বাংলাদেশ উদযাপন করছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। স্বাধীনতাযুদ্ধের যাত্রা শুরু হয় ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। সেই ভাষা আন্দোলনের মূল নায়কদের মধ্যে অন্যতম একজন আহমদ রফিক। একজন সংগ্রামী ভাষাসৈনিকের এমন নিঃসঙ্গ পরিস্থিতি মানতে নারাজ তার ভক্তরা।

তারা বলছেন, জীবনের পুরো অংশজুড়েই ‍তিনি দেশ নিয়েই ভেবেছেন, দেশের জন্যেই করেছেন। কখনও খোলা ময়দানে, কখনও কলমের খোঁচায়। খুব দ্রুতই তার পাশে এগিয়ে আসা উচিত রাষ্ট্রের।

একে/এইচকে