টিকিটধারী যাত্রীদের নির্বিঘ্নে প্লাটফর্ম ব্যবহার করে ট্রেনে চড়া ও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল রেলওয়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা, বিমানবন্দর ও জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশনে কয়েক ধাপে চেকিং করে প্লাটফর্মে যাত্রীদের প্রবেশ করানো হয়েছিল।

ট্রেনে ঈদযাত্রার শুরুর দিন অর্থাৎ ১৭ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত স্টেশন ব্যবস্থাপনার সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে মানুষের চাপে ভেঙে যায় স্টেশনগুলোর সেই কঠোর ব্যবস্থাপনা। সব বাধা উপেক্ষা করে ট্রেনের ভেতরে দাঁড়ানোর জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ট্রেনের ছাদে উঠে যায় ঘরমুখো মানুষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেছে নেয় অনিরাপদ যাত্রা। ঈদের সময় ট্রেনে ঘরে ফেরার সেই চিরচেনা আবারও ভেসে ওঠে। আবেগী কণ্ঠে ছাদে উঠা সবার একটাই মন্তব্য, ‘যে করেই হোক ঈদে বাড়ি যেতে হবে।’

স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কয়েকটি ট্রেনে অন্তত ৬ হাজার মানুষ ঢাকা স্টেশন অতিক্রম করেছে। বিনা টিকিটের যাত্রীদের স্টেশনে প্রবেশ প্রতিহত করতে রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা আহতও হয়েছেন।

স্টেশন কর্তৃপক্ষ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে জানা যায়, সন্ধ্যার পর থেকেই টিকিটধারী যাত্রীর বাইরে ঘরমুখো মানুষ স্টেশনের পার্কিং এরিয়াতে জমায়েত হতে থাকেন। মূলত টিকিট না থাকায় তারা প্রথম চেকিং জোন পার হতে না পেরে ফেরত এসে এখানে দাঁড়ায়। পরে ট্রেন ছাড়া আগ মুহূর্তে টিকিটধারী যাত্রীদের সঙ্গে ভিড় করে ধাক্কাধাক্কি করে চেকিং জোনগুলো পার হয়ে যায়। এ সময় নিরুপায় হয়ে পড়ে ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনার (টিটিই) ও আরএনবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পাশাপাশি রেলওয়ে পার্সেল সার্ভিস অংশে ও বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে তারা প্লাটফর্ম এরিয়াতে প্রবেশ করে। পরে টিকিটধারী যাত্রীদের পাশাপাশি তারা ট্রেনের ভেতরে জায়গা করে নেয়। যারা ট্রেনের ভেতরে দাঁড়ানো জায়গা পায়নি তারা উঠে পড়ে ট্রেনের ছাদে।

শুরুর দিকে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্যরা চেষ্টা করেন ঘরমুখো মানুষদের ট্রেনের ছাদ থেকে নামাতে। ২/১টি বগি থেকে তাদের নামাতে সক্ষম হলেও পরে তারা ব্যর্থ হন। ট্রেন ছাড়া আগে আগে তারা আবার ছাদে উঠে যায়।

এদিকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে স্ট্যান্ডিং টিকিটের দাবি তুলে সেখানে ভাঙচুর চালায় ঘরমুখো মানুষ। পরে সেখান থেকেও যাত্রীরা ট্রেনের ছাদে উঠে।

স্টেশন কর্তৃপক্ষ জানায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর মানুষজন যেসব ট্রেনের ছাদে উঠেছে, সেসব ট্রেনের গন্তব্য ছিল উত্তরবঙ্গের। অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে যাতায়াতের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে ট্রেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাহন। উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রামগামী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ও লালমনিরহাটগামী লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনে মানুষজন ছাদে উঠে রওনা হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার রাতে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দেখা গেছে, রাত ৮টায় ৩নং প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করে দ্রুতযান এক্সপ্রেস। প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় ট্রেনটি। এরপরে যারা ভেতরে জায়গা পায়নি তারা জায়গা নেন ছাদে। প্রায় দুই ঘণ্টা বিলম্বে ট্রেনটি ৮টা ৫০ মিনিটে ঢাকা ছাড়ে।

রাত সাড়ে ৮টায় ২নং প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায় কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস। সেখানেও একই অবস্থা তৈরি হয়। ছাদ ও ভেতরে কানায় কানায় পূর্ণ যাত্রী নিয়ে ১৫ মিনিট বিলম্বে রাত ৯টায় কমলাপুর স্টেশন ছাড়ে। লালমনি এক্সপ্রেসও ছাদ ভর্তি যাত্রী নিয়ে ১ ঘণ্টা ২১ মিনিট বিলম্বে রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে স্টেশন ছেড়ে যায়।

কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের ছাদে ওঠা জলিল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি অনলাইন ভালো বুঝি না, তাই ট্রেনের আসন কাটতে পারিনি। আজ গার্মেন্টস ছুটি হয়েছে। ভেবেছিলাম স্টেশনে এসে স্ট্যান্ডিং টিকিট কাটব। সেটাও পাইনি। তাহলে বাড়ি যাব কিভাবে?

তিনি আরও বলেন, শুধু আমি না। আমার মতো অনেকেই আছে যারা টিকিট ছাড়াই ট্রেনে উঠেছে। বাড়ি তো যেতে হবে। বাধ্য হয়ে ট্রেনের ছাদে উঠেছি।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ যারা ট্রেনের ছাদে উঠে যাত্রা করেছন তাদের বেশিরভাগই গার্মেন্টস কর্মী ও উত্তরবঙ্গের মানুষ। কারণ, ওই ট্রেনগুলো ছিল উত্তরবঙ্গের।

তিনি বলেন, আমরা প্রথমদিকে চেষ্টা করেছি তাদের প্রতিহত করতে। কিন্তু তারা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি। তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে আমিসহ রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সফিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জন্মভূমির প্রতি যে মানুষের ফিলিংস, বাড়ির প্রতি মানুষের যে টান- সেটা তো আর উপেক্ষা করতে পারি না। ভালোর মধ্যে কিছু তো একটু এদিক-সেদিক হবেই।

তিনি আরও বলেন, ৩টি ট্রেনের ছাদে মানুষ ওঠার ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার সকালের দিকে এমন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরপর আর হবে না ইনশাআল্লাহ।

এমএইচএন/ওএফ